চট্টগ্রাম–পানগাঁও রুট
৯ বছর আগে চালু হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা বহুল প্রত্যাশার পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনালে গতবছর মাত্র ২৭ হাজার টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছে। বছরে এক লাখেরও বেশি কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৩ সালে গড়ে তোলা এ কন্টেনার টার্মিনাল প্রতিষ্ঠার প্রায় ৯ বছরেও কোনো গতি পায়নি। পুরোবছরে ২৭ হাজার কন্টেনার হ্যান্ডলিং করলেও এর প্রায় পুরোটাই আমদানি কন্টেনার।
জানা যায়, ঢাকা এবং সন্নিহিতঅঞ্চলের কয়েক লাখ রপ্তানিপণ্য বোঝাই কন্টেনারের ছিঁটে ফোটাও পায়নি পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। বেহাল এ পরিস্থিতিতে রপ্তানিপণ্য বোঝাই কন্টেনার হ্যান্ডলিং বাড়াতে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে চলাচলকারি জাহাজগুলোকে সিডিউল মেনে চলাচলের উপর জোর দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, পাঁনগাও-চট্টগ্রাম রুটে অবশ্যই সিডিউল মেনে জাহাজ পরিচালনা করতে হবে।
দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে বহুমুখী সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৩ সালে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বিআইডব্লিউটিএর মালিকানাধীন ৫৫ একর জায়গার উপর এ কন্টেনার টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ঢাকামুখী কন্টেনারের চাপ কমানো, চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের গাড়ির চাপ কমানো, রাস্তার স্থায়ীত্ত্ববৃদ্ধি, ঢাকা অঞ্চলের আমদানি রফতানিকারকদের খরচ সাশ্রয়সহ বিভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে টার্মিনালটি গড়ে তোলা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ টার্মিনালে নিয়মিত কন্টেনার আনা নেয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত ঢাকা অঞ্চলের যেসব কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে সেগুলো ছোট আকৃতির জাহাজে বোঝাই করে পানগাঁও টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হবে। অপরদিকে ঢাকা অঞ্চলের রপ্তানিপণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলো পানগাঁও থেকে ফিরতি জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে। এখান থেকেই ফিডার ভ্যাসেলে ওই কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্টে পোর্টে চলে যাবে। এতে ঢাকা অঞ্চলের কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে আনা নেওয়ার বিদ্যমান ব্যবস্থায় মহাসড়ক এবং রেলওয়ের উপর যে চাপ পড়ে তা কমে যাবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে।
কিন্তু এত আয়োজনের পরও পাঁনগাও কন্টেনার টার্মিনাল গতি পায়নি। এ টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার আনা নেয়ার জন্য বিভিন্ন কোম্পনিকে জাহাজ পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীন নৌরুটে জাহাজ পরিচালনা করতে বেশ বিলম্ব করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পুরাতন কন্টেনার জাহাজ কিনে রুটটি সচল করার উদ্যোগ নিলেও তা ভেস্তে যায়। বর্তমানে ১৭টি ভ্যাসেল এ রুটে চলাচল করছে। অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজগুলো গড়ে একশ টিইইউএস কন্টেনার পরিবহন করতে পারে। কিন্তু জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেনার নিয়ে পানগাঁও টার্মিনালে গেলেও ফিরতি পথে কোনো কন্টেনার পায় না। এতে করে জাহাজ পরিচালনা ব্যয় বাড়ছে। প্রতিটি কোম্পানিই কমবেশি লোকসানের কবলে পড়ছে। আমদানিপণ্য বোঝাই কন্টেনারের পাশাপাশি ঢাকা অঞ্চলের রফতানিপণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলো পানগাঁও হয়ে পরিবাহিত হলে এ রুট সচল হয়ে উঠে এবং কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমান বৃদ্ধি পায়।
ঢাকা অঞ্চলের রফতানিকারকেরা তাদের পণ্য পানগাঁও টার্মিনাল থেকে না পাঠানোর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করে জাহাজের সিডিউলকে। তাদের মতে, রফতানিপণ্য বোঝাই কন্টেনার পানগাঁও টার্মিনালে পাঠালে ওখান থেকে যদি একদিনের মাথায় চট্টগ্রামে চলে আসে তাহলে তাদের সমস্যা হয় না। তারা চট্টগ্রাম থেকে ফিডার ভ্যাসেলে তা ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে পাঠাতে পারে। কিন্তু পানগাঁও থেকে নিয়মিত জাহাজ চলাচল না থাকার ফলে রফতানিপণ্য বোঝাই কন্টেনার ওখানে পড়ে থাকে। এটি কতোদিনে চট্টগ্রাম পৌঁছবে তার কোনো গ্যারান্টি থাকে না। ফলে ফিডার ভ্যাসেল এবং ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট থেকে মাদার ভ্যাসেল ধরে পণ্য রফতানি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ অনিশ্চয়তার জন্য রফতানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার নিয়ে কোন রফতানিকারকই পারতপক্ষে পানগাঁওমুখী হচ্ছেন না।
বিষয়টি অনুধাবনের পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিশেষ উদ্যোগ নেয়। চট্টগ্রাম পানগাঁও রুটে চলাচলকারী ১৭টি জাহাজ কোম্পানির প্রতিনিধিকে নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠক আহ্বান করে। বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর ১৭টি জাহাজের একটি সিডিউল প্ল্যান তৈরি করে দেয়া হয়। এ সিডিউল অনুযায়ী জাহাজগুলোকে চলাচলের কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো জাহাজ সিডিউল মিস করলে পরবর্তী জাহাজ ওই সিডিউলে প্রবেশ করে চলাচল করবে। এতে করে পানগাঁও থেকে রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার চট্টগ্রামে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কোন অনিশ্চয়তা থাকবে না। এ সিডিউল আগামী ছয় মাস বলবৎ থাকবে বলেও গতকাল জারি করা এক সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) স্বাক্ষরিত একপত্রে সিডিউলের বিষয়টি নিশ্চিত করে তা রক্ষা করার জন্য ১৭ জাহাজ কোম্পানিকে তাগাদা দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক চট্টগাম পানগাঁও রুটে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে নয়া সিডিউল ঘোষণার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ রুট গতিশীল করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
আনন্দবাজার/এম.আর