বিশ্বজুড়ে শিল্পবিপ্লব আর ব্যাপক শহরায়নের কারণে স্থাপন নির্মাণের প্রচলিত অপরিহার্য উপকরণ ইটের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে বহুগুণ। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ইট তৈরির ভাটা বা ইটখোলার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে হু হু করে। প্রতিবছর বিশ্বে যে দেড় হাজার বিলিয়ন ইট তৈরি হয়, তার মধ্যে ৩১০ বিলিয়ন ইট তৈরি হয় দক্ষিণ এশিয়ায়। এর মধ্যে আবার ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালে তৈরি হয় ৯০ ভাগ।
তথ্যমতে, বিশ্বে ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। দেশে সাত হাজারেরও বেশি ইটখোলা বা ইটভাটা থেকে বছরে উৎপাদিত হয় প্রায় ২৩ বিলিয়ন ইট। জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখছে ইটশিল্প। দেশের ইটখোলাগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের। পরিসংখ্যান বলছে, যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে আগামী ১০ বছরে ইটখোলার সংখ্যা ২ থেকে ৩ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। দিন দিন বেড়ে যাওয়া এসব ইটখোলায় বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
দেশে ইটশিল্পে বছরে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট মাটি ব্যবহার হয় ইটখোলায়। তবে ইট তৈরিতে আধুনিক পদ্ধতির প্রচলন কম হওয়ায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। দেশের প্রায় সাত হাজার ইটখোলার মধ্যে সাড়ে চারহাজার ইটখোলাতেই প্রাচীন ফিক্সড চিমনি পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন হয়। পাশাপাশি জিগজাগ, হাইব্রিড হফম্যান ও টানেল পদ্ধতিতেও ইট উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব টানেল পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা একেবারেই কম।
শুষ্ক মৌসুমে বায়ুমণ্ডলে ধুলাবালির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার সময়েই পুরোদমে ইট তৈরির কাজ চলে। এতে ইটখোলা থেকে নির্গত দূষিত উপাদানের কারণে মারাত্মকভাবে বায়ুদূষণ ঘটে। এসব উপাদানের মধ্যে প্রতিনিয়ম বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড। গবেষণা মতে, ইট পোড়াতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহারে ইটখোলা থেকে বছরে প্রায় ১৫ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড যোগ হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। মানবদেহে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে রেসপিরেটরি সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত করে। যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে ইটখোলার আশপাশে বসবাসরত মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য রোগ ছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত সালফার ডাইঅক্সাইডের কারণে মানুষ চোখ, নাক, গলাসহ অ্যাজমাটিক সমস্যার মুখে পড়ছে।
এদিকে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারি করা ১৯৯২ সালের প্রজ্ঞাপনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, কৃষি-জমিতে ইটভাটা নির্মাণ দণ্ডনীয় অপরাধ’। তবে বেশিরভাগ ইটভাটা মালিক এই নির্দৈশনার তোয়াক্কা করছেন না। এতে ফসলি জমির উর্বর টপ সয়েল উজার হয়ে উৎপাদনশূন্য হয়ে মাটি। তাছাড়া বেশিরভাগ ইটভাটায় কয়লার বদলে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে উজার হচ্ছে বন। দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে শত শত ইটভাটা। এসব ইটভাটার কারণে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও মধ্যভাগের জেলা টাঙ্গাইলেও এমন ইটভাটার সংখ্যা অনেক।
রংপুর:
রংপুরের পীরগঞ্জে প্রায় অর্ধ শতাধিক অবৈধ ইটভাটার গর্ভে যাচ্ছে কৃষিজমির টপ সয়েল (জমির উপরিভাগের মাটি)। কয়লার বদলে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ইট তৈরির মৌসুমকে ঘিরে ভাটাগুলোতে মজুদ করা হয়েছে বিশাল আকারের মাটির স্তূপ। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি ভাটায় ইট পোড়ানোর লক্ষ্যে আগুন দেওয়া হয়েছে। যার সবগুলোতে দেদারছে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বিধি অনুযায়ী অটোভাটা করার কথা থাকলেও উপজেলায় এবারে আরও অবৈধ দুটি ফিক্সড চিমনির ভাটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর ভাটাগুলোতে প্রায় ৩০০ একর জমির টপ সয়েল পোড়ানো হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ১৯৯২ সালের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ‘কৃষি-জমিতে ইটভাটা নির্মাণ দণ্ডনীয় অপরাধ’। কিন্তু পীরগঞ্জে তা মানা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পীরগঞ্জে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী মাত্র ৫ থেকে ৬টি অটোভাটা রয়েছে। ১৫টি ইউনিয়নে ৪৭টি ফিক্সড চিমনি ভাটায় ইট পোড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে অবৈধভাবে কৃষিজমির টপ সয়েল ও জ্বালানি হিসেবে কাঠের মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে। ফিক্সড চিমনির ওইসব অবৈধ ভাটা পরিবেশ অধিদফতর বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ যেন ভেঙে না দেয় সেজন্য কৌশলে বেশকিছু ইটভাটার মালিক হাইকোর্টে রিট করে ইট তৈরি অব্যাহত রেখেছে। তারা প্রতিবছরই এভাবে হাইকোর্টে রিট করে ইট ব্যবসা করে আসছে। আর ২৫ থেকে ২৬টি ভাটা পুরোটাই অবৈধভাবে চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ওইসব ভাটায় ফসলী জমি থেকে মাটি কেটে বিশাল মজুদ করা হয়েছে। কোথাও কয়লা চোখে পড়েনি। শুধু গাছপালা ও বাঁশের মোথা দিয়েই ইট পোড়ানো হচ্ছে। ভাটা মালিকরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউই আইন মানছেন না। দেদারছে কাঠ পোড়ানোর কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। তবে জমির মালিকরা জানান, প্রতিবিঘা (৫০ শতক) জমি আবাদের জন্য লিজ দিলে বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু ভাটায় মাটি বিক্রি করলে পাওয়া যায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা।
উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের দানিশনগর গ্রামে ভাড়া নেওয়া অবৈধ ফিক্সড চিমনির ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য প্রায় ২০ হাজার মণ কাঠ মজুদ রয়েছে। কুমেদপুর ইউনিয়নে দুটি ইটভাটার জন্য প্রায় দুই লাখ মণ কাঠ মজুদ করা হয়েছে। একই চিত্র উপজেলার সকল ইটভাটায়। ভাটা সংলগ্ন এলাকাবাসী জানান, যেভাবে কাঠের কালো ধোঁয়া হচ্ছে, তাতে স্বাস্থ্যহানি এবং পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের কাছে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধের দাবি জানাই। ভেণ্ডাবাড়ীতে মমিন মিয়ার ধানের চাতালেও প্রায় ৪০ হাজার মণ ছোট ছোট গাছের কাঠ ইট পোড়ানোর জন্য মজুদ করা হয়েছে।
উপজেলা ভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, এবারে ভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে বলে বিভিন্ন এলাকা থেকে সচেতন মানুষজন জানিয়েছেন। এ উপজেলায় মাত্র ৪ থেকে ৫টি ভাটার বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। কিছু ভাটার মালিক হাইকোর্টে রিট করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিধির বাইরে এবারে আরও দুটি ফিক্সড চিমনির নতুন ভাটা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, উন্নয়ন কাজের জন্যই ইট তৈরি করা দরকার। তবে তা বিধি অনুযায়ী হওয়া চাই। তবে তিনি জমির টপ সয়েলের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, জমি ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি মাটিতে বেশি পুষ্টি থাকে। যা ফসল উৎপাদনে খুবই সহায়ক। কৃষকদের অসচ্ছলতার সুযোগে ভাটা মালিকরা জমির মালিকদের উদ্বুদ্ধ করে ইট তৈরির জন্য কৃষি জমির টপ সয়েল কিনছে। ভাটায় প্রতিবছর টপ সয়েল ব্যবহার করায় জমির পুষ্টিগুণ ও উৎপাদন শক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আর কৃষকরা জমিতে সারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে টপ সয়েল তুলে নেওয়া অব্যাহত থাকলে ভতিষ্যতে জমিগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিরোদা রাণী রায় বলেন, ইতোমধ্যে ভাটা মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা যেন ভাটায় জ্বালানী হিসেবে কাঠ-খড়ি ব্যবহার না করে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টাঙ্গাইল:
টাঙ্গাইলে অবৈধ ইটভাটায় ছেয়ে গেছে। সরকারি আইন লঙ্ঘন করে ক্রমশ বেড়েই চলেছে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা। কৃষি জমির ওপর, বসত বাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে ইটভাটা স্থাপনের বৈধতা না থাকলেও এমনটাই দেখা মিলছে সরজমিনে। প্রতিটি ইটভাটার মধ্যে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরত্ব রাখার নির্দেশনা থাকলেও মানছে না ভাটার মালিকেরা। বর্তমানে জেলার ২৮৫টির মধ্যে ১৫৮টি ইটভাটা অবৈধ। এইসব ইটভাটার বেশিরভাগ কৃষি জমিতে ও বসতবাড়ি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে। এতে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র, জমির ফসল হচ্ছে না। পরিবেশ হুমকির মুখে। এতে বৈধ ইটভাটাগুলো কীভাবে লাইসেন্স বা পরিবেশের ছাড়পত্র পেলো তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সাধারণ মানুষ।
কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মাণ দণ্ডনীয় অপরাধ জেনেও ইটভাটায় দেদারছে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমির টপ সয়েল। বেশির ভাগ ইটভাটায় কয়লার বদলে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। আর ইট তৈরির মৌসুমকে ঘিরে ভাটাগুলোতে মজুদ করা হয়েছে বিশাল আকারের মাটির স্তূপ। এতে পরিবেশ দূষিত হওয়ার পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন। তারা প্রশাসনের কাছে দ্রুত ওই ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
কৃষি অফিস জানায়, ভাটায় প্রতিবছর টপ সয়েল ব্যবহার করায় জমির উর্বরতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আর কৃষকরা জমিতে সারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে টপ সয়েল তুলে নেওয়া অব্যাহত থাকলে ভতিষ্যতে জমিগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিবেশ অধিদফতরের সূত্রমতে, বর্তমানে জেলায় ২৮৫টি ইটভাটার মধ্যে পরিবেশগত ছাড়পত্র আছে ১২৭টির আর অবৈধ ইটভাটা আছে ১৫৮টি। এর মধ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার তিনটি ইটভাটারই ছাড়পত্র আছে। দেলদুয়ারে ইটভাটা ১টি অবৈধ ১টি বৈধ, কালিহাতীতে ১৩টির মধ্যে ৩টি বৈধ ১০টি অবৈধ, বাসাইলে ৯টির মধ্যে ২ টি বৈধ, ৭টি অবৈধ, ভূয়াপুরে ৬টির মধ্যে ১ বৈধ, ৫টি অবৈধ, সখিপুরে আছে ৮টির মধ্যে ৩টি বৈধ, ৫টি অবৈধ, গোপালপুরে ৬টির মধ্যে ৩টি বৈধ ৩টি অবৈধ, মধুপুরে ২০টির মধ্যে ১টি বৈধ ১৯টি অবৈধ, নাগরপুরে ২২টির মধ্যে ১৩টি বৈধ ৯টি অবৈধ, ধনবাড়ীতে ২০টির ২টি বৈধ, ১৮টি অবৈধ, মির্জাপুরে ১০৮টির মধ্যে ৭৬টি বৈধ, ৩২টি অবৈধ, ঘাটাইলে ৬৮টির মধ্যে ১৯টি বৈধ, ৪৯টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।
বেশিরভাগ ইটভাটা অবৈ ভাবে বছরের পর বছর ধরে চলছে। আর এইসব অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করার জন্য টাঙ্গাইলে কর্মরত বিভিন্ন পরিবেশবাদি ও সামাজিক সংগঠন দাবি জানিয়ে আসছে। ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ এ লাইসেন্স ছাড়া কেউ ইটভাটা চালু করলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও জেলার বৈধ এর চেয়ে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা বেশি। এ জন্য অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা দুই দণ্ডই হতে পারে।
এসব ইটভাটার কর্মকাণ্ডে জড়িতরা বেশির ভাগই প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকটা দেখেও না দেখার চেষ্টা করেন স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েক গজের মধ্যে ইটভাটা। এগুলোতে প্রকাশ্যে কাঠ পোড়ানো হয়। তা ছাড়া বেশির ভাগ ইটের ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে কম উচ্চতার টিনের চিমনি। ইট ভাটার ধোঁয়ায় আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বসতবাড়ী, কৃষি জমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই বেশিরভাগ ইটভাটা। কয়লা দিয়ে এসব ইটভাটাগুলোতে ইট পোড়ানোর কথা থাকলেও খরচ সাশ্রয়ের জন্য সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অনেকেই নির্ভয়ে প্রকাশ্যেই পোড়াচ্ছে কাঠ। এতে বনভূমি ধ্বংশ হয়ে পরিবেশের বিপর্যয় হচ্ছে। এসব ভাটাগুলো পড়েছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ও ভাটার ধোঁয়ায় আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
গালা গ্রামের হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের গ্রামে চারটি ইটভাটা রয়েছে। প্রত্যেকটি ইটভাটাই বসতবাড়ি, কৃষি জমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে। এরা কীভাবে ছাড়পত্র পেলো নাকি ঘুষ নিয়ে ছাড়পত্র দিলো তা আমার জানা নাই। উজ্জল মিয়া বলেন, ইটভাটার তাপে নারিকেল গাছের ফল ছোট হয়ে গেছে। গ্রামের মধ্যে থাকা ভাটায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে কৃষকের ফসলের। মাঝে মাঝে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন আসেন। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পরপরই ইটভাটা আবার চালু হয়ে যায়।
পরিবেশবাদি সংগঠন সবুজ পৃথিবীর পরিচালক শারমিন আলম বলেন, এইসব অভিযান করে কোনো লাভ হয় না। অভিযান করে ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও কেউ ইটভাটা বন্ধ করে না। মোবাইল কোর্ট চলে আসার পরেই আবার চালু হয় এইসব অবৈধ ইটভাটা। তাই আমাদের দাবি এইসব অবৈধ ইটভাটা গুলো বন্ধ করে দেওয়া হোক। অবৈধ ইটভাটা বন্ধের দাবি জানানো সংগঠনগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সবুজ পৃথিবী, লৌহজং নদী সুরক্ষা কমিটি।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, কৃষি জমির উপরের উর্বর মাটি দিয়ে ভাটায় ইট তৈরি করা হয়। এতে জমির ফসল ভালো হয় না। এছাড়াও ফলনও কমে যায়। এছাড়াও ইটভাটায় গাছ পোড়ানো হচ্ছে। একদিকে যেমন বনভূমি ক্ষয় হচ্ছে অপর দিকে কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, বিভিন্ন ধরণের পার্টিকুলেট ম্যাটার তৈরি হয়। এতে আমাদের মানুষের শ্বাসকষ্ট তৈরি করে। বসতভিটা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে যে সব ইটভাটা রয়েছে এতে করে প্রত্যেকটি মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইটভাটার কারণে বিভিন্নভাবে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছর আমরা অনেকগুলো ইটভাটাকে জরিমানা করেছি। এ বছরও আমাদের অভিযান চলবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা করা যাবে না। যেসব ইটভাটা বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে আছে সেগুলোর ছাড়পত্রও বাতিল করা হবে।
আনন্দবাজার/শহক