ঢাকা | রবিবার
২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঘোড়ারগাড়িতে বেশি সুবিধা

ঘোড়ারগাড়িতে বেশি সুবিধা


গতি বেড়েছে জীবন-জীবিকার
‘কী দ্যাকেন বাহে ঘোড়ারগাড়ি নোয়ায়, ইগলা (এসব) হামার আলু পরিবহন

ভাইরে আগের দিন আর নাই, রিকশাওয়ালায় তুলিয়া নিল মোর গাড়িয়ালী কামাই। এটি রংপুর অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি ভাওয়াইয়া গান। এক সময় গ্রামাঞ্চলের পরিবহন বলতে ছিল গরুগাড়ি। ক্রমান্বয়ে রিকশা সে স্থান দখল করে নেওয়ায় বিলুপ্তপ্রায় গরুগাড়ির গাড়িয়াল ক্ষোভে-দুঃখে ওই গানটি গেয়েছিলেন। তারপরও রাস্তা-ঘাট নেই, এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক’বছর আগেও বিশেষ করে মালামাল পরিবহনে গরুগাড়ির কদর ছিল। কিন্তু সে জায়গাও আজ দখল করে বসেছে ঘোড়ারগাড়ি।

ঘোড়ারগাড়ি বলতে এক সময় ছিল রাজা-বাদশাহদের বাহন। সাধারণ মানুষের কল্পনার মধ্যে ছিলনা ঘোড়ারগাড়িতে চড়ার কথা। গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রয়োজনে ঢাকা শহরে গেলে নবাবপুর রোডে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ারগাড়ি (টমটম) দেখে থমকে দাঁড়ান এক নজর দেখার জন্য। কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে ওই ঘোড়ারগাড়িতে চড়ে শখ মেটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজকীয় আদলে না হলেও ঘোড়া দিয়ে টানা গাড়ি এখন রংপুরের চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত এলাকায় জনপ্রিয় বাহন হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

জীবন-জীবিকার তাগিদে সময়ের চাহিদা মেটাতে মানুষ একেক সময় একেক পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়। ক’বছর আগেও রংপুর অঞ্চলে ঘোড়ারগাড়ির কথা খুব একটা ভাবার বিষয় ছিলনা। এতদাঞ্চলের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী বাহন বলতে ছিল গরুগাড়ি। ওই গরুগাড়িকে নিয়ে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী কতইনা বন্দনা করতেন। গরুগাড়ির চাকাসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ প্রস্তুত, ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল হাজার হাজার মানুষ। অনেক স্থানেই এটি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু কালের চাহিদা মেটাতে গিয়ে গরুগাড়ি এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বছর পাঁচেক থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ, আদিতমারী, হাতীবান্ধা, কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারীর তিস্তার চরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্যসহ মালামাল পরিবহনে ঘোড়ারগাড়ির প্রচলন শুরু হয়। ভ্যান সাদৃশ্য গাড়ির সামনে ঘোড়াজুড়ে দিয়ে ওই বাহনটি চলে। তিস্তার চরসহ প্রত্যন্ত গ্রামে রাস্তা-ঘাটের অভাবে যেখানে কোনো যান্ত্রিকবাহন চলাচল করে না, সেখানে এ ঘোড়ারগাড়িই একমাত্র ভরসা। জমি থেকে উৎপাদিত ফসল গোলায় নিয়ে যেতে জুড়ি নেই এ বাহনটির। দিনদিন পরিবেশবান্ধব এই ঘোড়ারগাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব এলাকায়।

সরেজমিনে গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের জয়রামওঝা, ইচলী চর, শংকরদহসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, বর্তমান সময়ে ক্ষেত থেকে আগাম আলু উত্তোলনের কাজ চলছে। নদীতে পানি কম বলে নৌকায় আলু পরিবহনে অনেক ঝক্কি-ঝামেলার কারণে ব্যবহৃত হচ্ছে এ ঘোড়ারগাড়ি। আলু নিয়ে তিস্তা নদী পার হয়ে আসছে ঘোড়ারগাড়ি কিংবা চর পেরিয়ে কেউবা আলু নিয়ে যাচ্ছেন তিস্তার ওপারে লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলায়।

চরের আলুচাষি লুলু মিয়া বলেন, ক্ষেত থেকে উত্তোলনকৃত আলু কিনতে প্রতিদিন সকালে ঘোড়ারগাড়ি নিয়ে চরে হাজির হন মহাজনরা। কালীগঞ্জের আলু ব্যবসায়ী আলমগীর জানান, এখন গরুগাড়ি পাওয়া যায় না। এছাড়া চরে রিকশা-ভ্যানও চলে না। তাই ঘোড়ারগাড়ি নিয়ে এসেছি। আব্দুল আউয়াল, কোরবান আলী বলেন, অভাবি এলাকা হিসেবে পরিচিত গঙ্গাচড়ায় তিস্তার চরে ব্যাপক আলু চাষ হওয়ায় বছর পাঁচেক ধরে ঘোড়ারগাড়ির প্রচলন দেখা যায়। মহিপুর এলাকার চাষি তারেক মিয়া ঘোড়ারগাড়িতে আলু নিয়ে যাচ্ছিলেন নদীর ওপারে। তিনি জানান, নদীতে পানি না থাকায় নৌকায় খুব ঝামেলা, তাই ঘোড়ারগাড়িই ভরসা। ঘোড়ারগাড়িতে ৫ থেকে ৬ বস্তা আলু (১০ থেকে ১২ মণ) পরিবহন করা যায় বলে তিনি জানান। ইচলী চরের বকুল মিয়া, আফছার আলী বলেন, ‘কী দ্যাকেন বাহে ঘোড়ারগাড়ি নোয়ায়, ইগলা (এসব) হামার আলু পরিবহন।’

ঘোড়ারগাড়ির চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গাড়ি তৈরির খরচ ও ঘোড়ার দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকায় অনেকেই এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে। গাড়ি চালানোর উপযোগি একটি ঘোড়া ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায় বলে তারা জানান। এ পেশাকে পাকাপোক্ত করতে চরাঞ্চলে অনেকে ঘোড়া পালনও করছেন। শংকরদহ চরের ঘোড়ারগাড়ি চালক আমিনুর রহমান জানান, মালামাল বহন করে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। ঘোড়ার খাদ্যের যোগান দিয়েও এতে তার সংসার চলে। গরুর চেয়ে ঘোড়ার দাম কম এবং তেমন ঝুঁকি নেই বলেও জানান তিনি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় রংপুর অঞ্চল থেকে ঐতিহ্যবাহী গরুগাড়ি বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হলেও তার স্থান দখল করে নিয়েছে এই ঘোড়ারগাড়ি।

সংবাদটি শেয়ার করুন