বিনা অপরাধে জেলে একযুগ
শিশু বয়স থেকে ১২ মামলায় ১২ বছর জেল খাটা সাতক্ষীরার সেই নজরুল এখন জীবনমৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই পায়ে সাড়ে সাত কেজি ওজনের ডান্ডাবেড়ি পরে টানা ১২ বছর ১৮ দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন। একডজন মামলা যন্ত্রনার সমাপ্তি যখন হয়, তখন নজরুলের বয়স ২৫ বছর। বয়সের পরিক্রমায় নজরুল এখন জটিলরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পথযাত্রী। নজরুল ইসলাম বেসরকারি এবি ব্যাংকের একজন পিওন। এখনও কর্মরত সাতক্ষীরা শাখা অফিসে। অসুস্থতার কারণে এখন আর তিনি অফিসে যেতে পারছেন না। এখন লড়াই করছেন মৃত্যুর সঙ্গে।
শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের ট্যাংরাখালি গ্রামের আরশাদ আলী গাজীর ছেলে নজরুল ইসলাম। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৯৮০ সালে দারিদ্রতার কষাঘাতে কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হতে হয় তাকে। এরপর খুলনার খালিশপুর থানার কাশিপুর এলাকার আহমদ আলীর বাড়িতে আশ্রয় হয় নজরুলের। পেটেভাতে কাজকর্ম করে তার দিন চলছিল কোনোমতে। দরিদ্র পিতা-মাতার প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতে না পারার যন্ত্রনায় নজরুল শরনাপন্ন হন খুলনার কয়রা উপজেলার বেতকাশি গ্রামের আব্দুল মোতালেবের। মোতালেব তাকে একটি রিকশা কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রিকশার জন্য মোতালেবের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন আগের রাতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। হতাশ নজরুল বাড়িতে ফির আসার সময় রাস্তায় পুলিশের মুখোমুখি হয়। পুলিশ তাকে জেরা করে, কেন তুই এ বাড়িতে এসেছিস। মোতালেব তো পাক্কা চোর। তুইও চোর নিশ্চয়ই। এমনটি বলেই তাকে আটক করে পুলিশ। নজরুলের কোনো আকুতি মিনতি সেদিন শোনেনি পুলিশ। এরপর তার ওপর অস্বাভাবিক নির্যাতন চালানো হয়। তার হাতে আঙুল, হাঁটু এমনকি পায়ের হাড়, হাতের কনুইতে নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। এমন অবস্থায় তার ঘাড়ে ওঠে গ্যাং কেসের ১২টি ডাকাতি মামলা। ১৩ বছর বয়স থেকেই এ ১২ মামলায় নজরুল ইসলাম খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বরিশালসহ বিভিন্ন কারাগারের সেলে আটক ছিলেন। এরই মধ্যে একটি ডাকাতি মামলায় তার সাত বছরের কারাদন্ড হয়। নজরুলের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলাই ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। এ ব্যাপারে তার এক নিকট আত্মীয়কে দোষী করে নজরুল বলেন, তিনিই প্রভাব খাটিয়ে তাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করিয়েছে।
জেল জীবনের এক পর্যায়ে ১৯৯২ সালে বিষয়টি নজরে আসে সংবাদকর্মীদের। দৈনিক ইত্তেফাকের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি প্রয়াত এ্যাডভোকেট হাসান আওরঙ্গী ‘বিনা অপরাধে ১৩ বছরের নজরুল ইসলাম ১২ মামলায় জেল খাটছেন’ শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চে একজন আইনজীবি সুয়োমটো রীট করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি মোজম্মেল হক ও বিচারপতি মাহফুজুর রহমান, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বেশ কয়েকজনের কাছে তাকে আটকাদেশের কারণ দর্শানো এবং একইসঙ্গে কেন তাকে মুক্তি দেওয়া হবে না তার জবাব চান। এর পরই নজরুল ইসলাম জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন ১৯৯২ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ২৭/১১/১৯৮০ থেকে মুক্তির দিন পর্যন্ত টানা ১২ বছর ১৮ দিন জেল খেটে ক্লান্ত হয়ে নজরুল ফিরে আসেন। আদালত সরকারকে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং একইসঙ্গে তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও তা প্রতিপালিত হয়নি। এসময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় আরব বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা তাকে পিওনের চাকরিতে নিয়োগ দেয়। সেই নজরুল এখন শয্যাশায়ী। তার শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ পুরোপুরি চেতনাহীন হয়ে গেছে। একইসঙ্গে দুই হাত এবং নির্যাতনের স্থানগুলিতে প্রচন্ড প্রদাহের সৃষ্টি হয়েছে।
নজরুলের স্ত্রী মনিরা পারভিন অশ্রু জড়িত কন্ঠে বলেন, কলেজপড়ুয়া মেয়েসহ দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। কর্মস্থলে না যেতে পারায় এবং ওষুধপত্র কিনতে গিয়ে তার জমানো সব টাকা শেষে করে ফেলেছেন। তিনি আরও বলেন, আমি কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। এমনকি কোন সরকারি সহায়তাও পাইনি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ কর বলেন, আমি বিনয়ের সঙ্গে আপনার কাছে করুনা প্রার্থনা করছি। আমাকে জীবনে রক্ষা করুন।