- নির্দেশনা মানেন না মালিক-শ্রমিকরা
- নির্দেশনা বাস্তবায়নে আগ্রহ নেই কর্তৃপক্ষের
- ফিটনেসবিহীন পরিবহনে সেবার মান বাড়ানো অসম্ভব: বিশেষজ্ঞরা
- যাত্রী সেবায় কর্তৃপক্ষের নজরদারির দাবি যাত্রীদের
রাজধানীর গণপরিবহনে যাত্রীসেবার মান নিয়ে সমস্যা দীর্ঘদিনের। দফায় দফায় ভাড়া বাড়ানো হলেও সেবার মানে তা প্রভাব ফেলে না। বরং যাত্রীদের হয়রানি দিন দিন বেড়েই চলে। অনেকেই বলছেন, রাজধানীতে গণপরিবহনে এখন সেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার নির্দেশনা দেয়া হলেও তোয়াক্কা করেন না মালিক-শ্রমিকরা। যে কারণে কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় যাত্রীসেবা সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনা। গণপরিবহনে যাত্রী সেবা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর কঠোর প্রয়োগ না থাকার কারণেই সেবার মান কমছে’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যেকোনোভাবে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করতে হবে। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীসেবার মান যেমন ঠিক রাখছেন না তেমনি সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে মানছেন না। সড়কে আইন ও সরকারি নির্দেশনা মেনে চলার চেয়ে মুনাফা লাভের দিকেই বেশি নজর থাকছে তাদের। এক্ষেত্রে যাত্রীদের বলার মতো কিছুই থাকে না। তারা সেবার পরিবর্তে অনেক সময় হয়রানির শিকার হন। এ ব্যাপারে কারো কাছে অভিযোগ দেয়া তো দূরের কথা, তারা নীরবেই মেনে নেন সব কিছু।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে আরামদায়ক আসন বা সিট স্থাপনের নির্দেশনা থাকলেও কোথাও তা মানা হচ্ছে না। বেশিরভাগ গাড়িতেই সরকার নির্ধারিত আসনের চেয়ে ১০ থেকে ১৫টি আসন বেশি রয়েছে। ফলে যাত্রীদের চাপাচাপি করে বসতে হয়। সিট কাভারগুলো এতোটাই ময়লাযুক্ত যে অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীরা সিটে না বসে দাঁড়িয়েই যাতায়াত করেন। অধিকাংশ গণপরিবহনের জানালার গ্লাস ভাঙাচোরা। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই গাড়ির ভেতর পানি ঢুকে যাত্রীদের ভিজিয়ে দেয়। শীতকালে কুয়াশা আর ঠাণ্ডা বাতাসের তোড়ে জ্বর-সর্দি পর্যন্ত লেগে যায় অনেকের। অনেক পরিবহনের আবার ছাদও ফুটো। ফ্যান নেই অনেক বাসে। থাকলেও সেগুলো ঠিকমত চলে না।
অন্যদিকে, আবার আসন খালি না থাকলেও যাত্রী তোলা বন্ধ থাকে না। যাত্রীদের গাদাগাদি বাদুর ঝোলা হয়ে চলাচল করতে হয়। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁয়ের মতো রয়েছে পকেটমারের দৌরাত্ম্য। ছোট গণপরিবহনে পেছনের সিটে চারজন বসার নিয়ম থাকলেও বসানো হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয়জন। চালকের বামে তিনজনের সিটে বসানো হচ্ছে চার থেকে পাঁচজন করে। শুধু তাই নয়, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে ইঞ্জিন কাভারের ওপর বিপজ্জনকভাবে বসানো হচ্ছে ৪ থেকে ৫ জন করে।
নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সামনের দিকের নয়টি সংরক্ষিত আসন বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেক গণপরিবহনে তা মানা হয় না। বেশিরভাগ সময় সংরক্ষিত আসনগুলোতে পুরুষদের বসানো হয়। নারী-শিশুদের দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যায়। অনেক সময় নারীরা বসতে চাইলে তর্কবিতর্ক বেঁধে যায়। এ ব্যাপারে কোথায় অভিযোগ দেয়ার সুযোগ পান না নারী যাত্রীরা। তাছাড়া প্রতিনিয়ত নারী ও শিশুদের অধিকমাত্রায় ইঞ্জিনকাভারে বসিয়ে দেয়া হয়। এমনকি চালকের পেছনের টুলবক্সের উপর সব সময়ই নারী-শিশুদের বসানো হয়।
এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে গেলেই অনেক চালক হেলপার তেড়ে আসেন। যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। যা অনেক সময় হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায়। অনেক সময় যাত্রীদের লাঞ্ছিত হতে হয়। যাত্রী সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণপরিবহনের হেলপাররা বলে থাকেন, এটা লোকাল বাস, প্রাইভেটকার না। আপনার যদি এতকিছুই লাগবে তাহলে সিএনজিতে যান, বাসে উঠছেন কেন? বাড়তি ঝামেলা এড়াতে তাই অধিকাংশ যাত্রীই চুপসে যান।
বাংলামোটরে কথা হয় জাহিদুল ইসলাম নামে এক বাস যাত্রীর সঙ্গে। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, বাসগুলোর অবস্থা খুবই বাজে। উঠলেই অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে এবং ময়লাযুক্ত সিটের দুর্গন্ধে মাথা ঘুরতে থাকে। নিয়মিত অফিস করতে হয় তাই বাধ্য হয়ে বাসে যাতায়াত করতে হচ্ছে। আগের তুলনায় ভাড়া অনেকটাই বেড়েছে। অথচ সেবার মান আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। জাহিদুল ইসলাম আরো বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে চলাচল করছে ফিটনেসবিহীন বাস, অথচ কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয় না। তার দাবি, এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। তার ধারণা, নিয়মিত তদারকি করলে সেবার মান বাড়তো।
এদিকে, রাজধানীর মৎসভবনের সামনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের চেকপোস্টে দেখা গেছে, এক চালকের লাইসেন্স রয়েছে শুধুমাত্র প্রাইভেট গাড়ি চালানোর। সেই লাইসেন্স দিয়েই তিনি চালাচ্ছেন গণপরিবহন। শুধু তাই নয় অনেক সময় হেল্পারকে দিয়েও চালানো হচ্ছে গণপরিবহন। এতে চরম ঝুঁকিতে থাকতে হয় যাত্রীদের। মনের অজান্তেই হেলপারকে চালক ভেবে গণপরিবহনে যাতায়াত করছেন। কে চালক আর কে হেলপার সেটা বুঝে উঠতে পারেন না যাত্রীরা।
যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী শাকিল আনন্দবাজারকে বলেন, বার বার ভাড়া বাড়লেও গণপরিবহনে যাত্রীসেবার মান বাড়ানো তো দূরে থাক প্রাপ্য সেবাটুকুও দিচ্ছে না তারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তদরকি করার কথা থাকলেও তারা কখনো যাত্রীর অধিকার এবং সেবার মান নিয়ে কাজ করছে না। যখনই ভাড়া বাড়ানোর কথা এসেছে তখনই তারা সেটা নিয়ে কাজ করেছে। তারা শুধু পরিবহন মালিক শ্রমিকদের অংশটুকু দেখে, সাধারণ যাত্রীদের সেবার বিষয়টা কখনই দেখে না। যে কারণে নগর পরিবহনের ভাড়ার সঙ্গে যাত্রীসেবার মানের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
গণপরিবহন কখনই জনবান্ধব হয়নি দাবি করে কেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে নগর পরিবহনের বড় একটা অংশের ফিটনেস নেই। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কাউকেই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন দিয়ে তো কখনও সেবার মান বাড়ানো সম্ভব না।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, গণপরিবহনে যাত্রীরা প্রতিনিয়তই তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার হচ্ছেন মালিক-শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারি আচরণে। ফলে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই চলছে। যে ব্যাপারে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকর কোনো তদারকি নেই। তবে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে লিখিতভাবে কোনো অভিযোগও আসছে না। যে কারণে আমরা পদক্ষেপ নিতে পারছি না। কেউ যদি লিখিত অভিযোগ করেন তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
নগর পরিবহনে নিম্নমানের যাত্রীসেবার কথা স্বীকার করে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, রাজধানীতে চলাচলরত পরিবহনগুলোতে কিছু সমস্যা আছে। যাত্রীসেবার মান উন্নয়নে মালিক সমিতির পক্ষে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সমস্যা সমাধান করে যাত্রীসেবার মান উন্নয়নে করণীয় সবকিছু করার চেষ্টা করছে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
আনন্দবাজার/শহক