ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভিক্ষা নয় কর্মসংস্থান চান তারা

ভিক্ষা নয় কর্মসংস্থান চান তারা

বিজয়ের দিনে এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়া নেই

অন্যের কাছে হাত পেতে কিছু চেয়ে নেওয়া মানুষও আছে এই সুরম্য রাজধানীতে। মোড়ে মোড়ে, অলি-গলিতে, জনাকীর্ণ এলাকা কিংবা বাজারে চোখে পড়ে তাদের। তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। কেউ হয়তো আগে ছোট খাট চাকরি করতেন। কেউ বা ব্যবসা করতেন, তবে এখন বাধ্য হয়ে সাময়িক মানুষের কাছে হাত পাতছেন। আবার কেউ কেউ ভিক্ষাকে পেশা হিসেবেই নিয়েছেন। তবে প্রতিবন্ধী জাকির হোসেন আর জাহাঙ্গীর হোসেনের গল্পটা অন্যরকম। তারা এখন মানুষের কাছে হাত পাতলেও আগে ব্যবসা করতেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে এখন রাজধানীর রামপুরা এলাকায় মানুষের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতছেন। যদিও তারা ফিরতে চান কর্মে, সেই আগের ব্যবসায়। তারাও স্বচ্ছল হতে চান নিজ পরিশ্রমে।

বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবসের দিনে তারা দুজনের দেখা হাতিরঝিলের ব্রিজের উপর। প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের জন্য বিশেষভাবে বানানো একটি অটো চালাচ্ছেন একজন। আরেকজন দাঁড়িয়ে মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছেন। এভাবে তারা বিজয়ের আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছেন। তারা একজন আরেকজনের বন্ধু। আগে একই বাসায় থেকে ভিক্ষা করতেন রামপুরা এলাকায়। কিন্তু এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন আলাদা আলাদা বাসায়। অবসর সময়ে প্রায়ই ঘুরতে বের হন।

তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই চাকরি করেন আর ছোট ভাই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। জন্মগতভাবেই তিনি প্রতিবন্ধী। হাঁটতে হয় লাঠিতে ভর দিয়ে। বর্তমানে রামপুরার ওলনবাজারে স্ত্রীকে নিয়ে তার বসবাস। ৭ থেকে ৮ বছর আগে বাবার সঙ্গে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। কিন্তু এখন সংসার চালাচ্ছেন ভিক্ষা করে।

জাহাঙ্গীর আনন্দবাজারকে বলেন, আমি জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। একদিনের জন্যও স্বাভাবিকভাবে হাঁটিনি। আমার অন্য ভাইবোনেরা সবাই সুস্থ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে। আর আমি লাঠিতে ভর দিয়ে কোনোভাবে হাঁটি। আগে এ অবস্থাতেই বাবার সঙ্গে কাঁচামালের ব্যবসা করতাম। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর তা আর হয়নি। তাই এখন ভিক্ষা করে সংসার চালাই।

জাহাঙ্গীর আরো বলেন, আমি আমার পরিবার নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। আমার সন্তানদের যেন কখনও কেউ বলতে না পারে ওই যে ভিক্ষুকের ছেলেমেয়ে যায়। আমি দিন-রাত পরিশ্রম করতে রাজি। শুধু একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা চাই। এই বিজয়ের দিনে এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না।

জাকির হোসেনের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। সুস্থ হয়ে দুনিয়ার আলো দেখেছেন তিনি। কিন্তু টাইফয়েড জ্বরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ৫ ভাই এক বোনের সংসারে তিনি সবার বড়। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। স্ত্রী ও ৭ বছর বয়সী এক কন্যাকে নিয়ে থাকেন আফতাবনগর ভুঁইয়া বাড়িতে। এক সময় মালিবাগ এলাকায় ফুটপাতে চা-পানের দোকান ছিলো। ব্যবসা করেই চালাতেন সংসার। কিন্তু প্রশাসন একাধিকবার ফুটপাত দখলমুক্ত করায় বারবার পুঁজি হারিয়ে পথে নামেন। ব্যবসার মূলধন জোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়েই নামেন ভিক্ষাবৃত্তিতে।

জাকির হোসেন আনন্দবাজারকে বলেন, সুস্থ-স্বাভাবিক এক জীবন ছিল আমার। সবার মতো হেসে-খেলে জীবন চলতো। যদিও অভাবের সংসার ছিলো আমাদের। হঠাৎ একদিন টাইফয়েড জ্বরের কবলে পড়ি। জ্বরে আমার পা দুটো পঙ্গু হয়ে যায়। এরপর থেকে এক অভিশপ্ত জীবন পার করতে শুরু করি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মালিবাগ এলাকায় ফুটপাতে চা-পান-সিগারেটের একটা টং দোকানে ব্যবসা শুরু করি।

কিন্তু পুলিশ আমাকে খুব জ্বালাতন করতো। প্রায়ই আমার দোকান ভেঙে দিতো। কত টাকা আর কামাই করতাম। পরে ধার-দেনা করে আবার ব্যবসা চালাতাম। আমি গরিব হতে পারি। কিন্তু আত্মসম্মান বোধ আছে। বারবার ভেঙে দেয়া দোকান আর ঠিক করতে পারিনি অর্থ সংকটের কারণে। বাধ্য হয়েই নামতে হয়েছে ভিক্ষায়।

জাকির হোসেন আরো বলেন, চলাচলের সুবিধার জন্য এক ভদ্রলোক আমাকে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। ভাবছি এ গাড়িতে করে ছোটখাটো ব্যবসা চালিয়ে নিবো। কিন্তু মালামাল বহন করার জন্য গাড়িতে কিছু কাজ করাতে হবে। পণ্য কিনতেও টাকার প্রয়োজন যা আমার কাছে নেই। পরিবার নিয়ে যেন সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারি সে জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা চাই। কেউ যদি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন তাহলে আমরা ভিক্ষা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। আমাদের একটা ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, পুলিশ ভাইয়েরা যেন আমাকে অযথা হয়রানি না করেন সে নিশ্চয়তা চাই।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন