শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্লভ এই ছবির মানুষরা কোথায়?

দুর্লভ ছবির এই তিন মুক্তিযোদ্ধাকে এখনও কোনো উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি

মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে খালেক, মজিদ ও মজিবর এই তিনজনের সমন্বয়ে তোলা ছবিটি অন্যতম। ছবির তিনজনই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৭১’র যুদ্ধে এই তিন কিশোরযোদ্ধা দেখিয়েছিল অসিম সাহসিকতা। যার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে দুর্লভ এই ছবিতে। ওরা বীর ছিল, আছে। জন্ম-জন্মান্তর ওরা জাতির কাছে চিরবীর হয়ে বেঁচে থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অধিকাংশ প্লে-কার্ড, ফেস্টুন ব্যানারসহ পাঠ্যবইয়ের গল্পের পচ্ছেদেও ছবিটি ব্যবহার হয়ে আসছে। “যে ছবি আজ বাংলার ঘরে ঘরে, তাঁদের খোঁজ আজ কে রাখে? এটিকি শুধুই ছবি? নাকি ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের বীরত্বের প্রতিচ্ছবি। সুপরিচিত এই ছবিটি এখনও বাংলার ঘরে ঘরে থাকলেও এই তিন বীরের পরিচয় ও দু:সাহসিকতার ব্যতিক্রমী কোন স্বীকৃতি মেলেনি।

এদের একজনকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে জীবনযুদ্ধ শেষ করতে হয়েছে। আরেকজনকে কখনও কারখানার শ্রমিক আবার কখনও বা নৌকার মাঝি হয়ে উপার্জন করতে হয়েছে। স্বাধীনতায় অগ্রণী ভূমিকায় নেই এদের বাড়তি কোন সম্মাননা। তিনজনের মধ্যে দুজনেই দীর্ঘ সময়ে পায়নি সম্মানজনক কোন উপার্জনের উৎস। ছবির দুরন্ত তিনযোদ্ধার পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধে অবদান আর তাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা হয়। এ প্রতিবেদকের কাছে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের কথা তুলে ধরেন।

ছবিতে থাকা তিনজনই টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের মুশুরিয়া গ্রামের কিশোর। ছবির তিনজনের মধ্য সবার সামনে যিনি গ্রেনেড ছুড়ছেন তিনি কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। মাঝে রাইফেল হাতে আব্দুল মজিদ। বামে রয়েছেন মজিবর রহমান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানকে স্মরণীয় রাখতে আলোচিত ফ্রেমে আটকে পড়েন এই তিন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর গোধূলিলগ্নে ময়মনসিংহের সম্ভুগঞ্জে পাকসেনাদের একটি শক্ত ঘাটির ভাংকার ধ্বংসের চিত্রটি ফ্রেমে আটকে রাখেন মানিকগঞ্জের নাইম উদ্দিন নামের এক ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধে এই তিন বীরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেও ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ছবিটি প্রকাশের পর স্বজনরা জানতে পারে ওরা তখনও বেঁচে আছেন।

আরও পড়ুনঃ  পদ্মা সেতুর ঋণ শোধে ২০৫৭ সাল

কথায়-কথায় বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান ও সাহসিকতার পরিচয়। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। তিনি মুশুরিয়া গ্রামের মৃত-হযরত আলী ও রুপজানের ছেলে। মজিবর রহমান ওই গ্রামের মৃত মনসের আলী ও মৃত সখিনা বেগমের সন্তান। আব্দুল মজিদও একই গ্রামের মৃত সলিম উদ্দিন ও সোনাবানুর সন্তান। এদের মধ্যে কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক ছিলো সর্বালোচিত। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি আনন্দবাজারকে জানান, তাঁদের দুঃসাহসিকতার কথা।

দুর্লভ সেই ছবির তিন জনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকছবির তিনজনের মধ্য সবার সামনে যিনি গ্রেনেড ছুড়ছেন ।

প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ :
খালেক, মজিদ ও মজিবর ওরা প্রায় সমবয়সী। তখন প্রায় ১২ থেকে ১৩ বছরের কিশোর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ওরা প্রেরণা পায়। যুদ্ধ সুনিশ্চিত এমন ধারনা ছিলো তাদের। ২৫ মার্চের কালো রাত ওরা বুঝতে পারে যুদ্ধ সন্নিকটে। ২৬ মার্চ থেকে সংকল্প নেন দেশকে বাঁচাতে সংঘবদ্ধ হতে হবে। প্রথমে মনে করেন সেনাবাহিনীই পারবে দেশকে মুক্ত করতে। অনিশ্চয়তা দেখে সমবয়সীদের সংঘবদ্ধ করতে থাকে ওরা। মে’র শেষের দিকে ওরা ২১ জন বন্ধু মিলে নৌকাযোগে ইন্ডিয়ার মাইনকার চরে চলে যান। তিনদিন পর তাদের মেডিকেল হয়। তুরা ক্যাম্পে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সেখানে আলফা কোম্পানীর নিয়ন্ত্রনে ২১ দিন ফ্রন্টফাইটার অতঃপর ৭দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ৭শ’ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা দেশে ফেরেন। ওদের কৌশল ছিল, সুযোগ বুঝে শত্রুসেনাদের ওপর আকস্মিক হামলা, পরক্ষণেই ইন্ডিয়াতে আত্মগোপন করা। কিছুদিন পর সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু হয় প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। ৭১’র ৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী (ইন্ডিয়ান আর্মি ৬ বিহার) রেজিমেন্টের সাথে সরাসরি যুদ্ধে নামেন। তবে তাদের বন্ধু তোফায়েল (তুলা মিয়া) মেডিকেল আনফিট হয়ে দেশে ফিরে পরোক্ষভাকে যুদ্ধে অংশ নেন। শুধু পাক সেনাদের ওপর গুলি বর্ষণ করেননি ওরা, সাহসিকতার সাথে ধ্বংস করেন শত্রুসেনাদের বেশ কয়েকটি ঘাঁটি। তারই একটি প্রতিচ্ছবি আলোচিত এই ছবিটি।

সম্মাননার দাবি :
সাদামনের মানুষ আব্দুল খালেক। হৃদয়জুড়ে শুধুই দেশপ্রেম। অস্বচ্ছলতার পরিচয় ভাঙা বাড়িটিই তার সাক্ষী। মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতে তাঁর আত্মসম্মানে বাঁধলো। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা লম্বা দেখে কেঁদে বললেন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে দেশ যেমন স্বাধীন হতো না তেমনি টাঙ্গাইল না থাকলে এতো মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যেত না। অথচ দুর্লভ ছবির সেই তিন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এখনও কোন উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি। রাস্তায় টাঙানো তাঁর নিজের ছবি দেখেতে গিয়ে অনেক সময় গলাধাক্কা খেতে হয়। সাদাসিধে পোশাকে তিনিই যে ছবির মানুষটি তা অন্যকে বোঝাতে বেগ পেতে হয়। রাজধানীর খিলক্ষেত ক্যান্টনমেন্টের সামনে এ ছবির ব্যয়বহুল ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে। অথচ নিজের উপজেলার মানুষকে ছবি দেখিয়ে নিজের পরিচয় দিতে হয়। নেই কোন প্রতিকী ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রায় আড়াইশ’ কবিতা লিখেছেন আব্দুল খালেক। অর্থের অভাবে তা প্রকাশ করতে পারেন নি। তিনি গোগ্রীন অটবি লি. এর গুলশান শাখার এ্যাম্বাসেডর পদে চাকুরি করতেন। অটবির ব্যবসায়িক অবস্থা মন্দা থাকায় বেতন বকেয়া পড়ে। এতে চাকুরি ছেড়ে অবসর চলে যান চট্টগ্রামের ফয়েজলেকে। মাতৃভূমির টানে ফের মুশুরিয়ার পিতৃভিটে বাড়িতে থাকছেন। খালেকের ঘরে রয়েছে চার ছেলে মেয়ে। ছেলেরা পৃথক হওয়াতে সরকারি ভাতাটাই এখন তাঁর একমাত্র উপার্জন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও কর্মকান্ডের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন সম্মাননা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।

আরও পড়ুনঃ  ডেঙ্গু আক্রান্ত ৪১ রোগী হাসপাতালে!

এদিকে, মজিবর রহমান ২০১৪ সালে মারা যান। মজিবর রহমানের স্ত্রী সাহাতন বেগম জানান, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মজিবর রহমান রেখে গেছেন চার ছেলে। আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জীবিকার খোঁজে রিকশা চালাতে হয়েছে মজিবর রহমানকে।

অপরজন আব্দুল মজিদ। তিনি ব্যাটেলিয়ান আনসার-এ প্লার্টুন কমান্ডার পদ থেকে অবসরে আসছেন। বাড়ির পুকুরে মাছ চাষ করে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। খালেকের মতো একই ধরনের কথা বললেন তিনিও। তার তিন মেয়ে। মজিদ পরে চাকুরি করলেও ওই সময়ে অর্থের অভাবে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করতে পারেননি। এটি কি শুধুই ছবি ? প্রশ্ন এলাকাবাসীসহ সুশীল সমাজের। যদি ছবির আড়ালে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ বীরত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে তাহলে এদের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করার দাবি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের।

স্থানীয়দের প্রত্যাশা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিশেষ ছবির একটি ভাস্কর্য নির্মাণ হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিশেষ জায়গায় নাম লেখাতে পারবে দেলদুয়ার উপজেলা। এই তিন বীর, তাদের স্বজনসহ স্থানীয় সুশীল সমাজ সরকারের কাছে জোর দাবি জানান, আলোচিত ছবির এ তিন যোদ্ধাকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারিভাবে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করে তাঁদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হোক।

দেলদুয়ার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবু তাহের বাবলু বলেন, আলোচিত এই ছবির তিনজনকে তিনি চেনেন। তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই দুর্লভ ছবিটিও তাদের। তিনিও ভাস্কর্যটি নির্মাণের জন্য সরকারে কাছে দাবি জানান। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের জন্য একটি ঘর বরাদ্ধ হয়েছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে। দেলদুয়ার উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন কবির বলেছিলেন, এই তিন কিশোর যোদ্ধাদের স্মরণীয় করে রাখতে একটি ভাস্কর্য নির্মাণের চেষ্টা চলছে। জেলা পরিষদের সহযোগিতা পেলে একটি ভাস্কর্য তৈরি করা সম্ভব হবে। তিনি বদলী হওয়ার পর ভাস্কর্যটি আর হয়ে উঠেনি।

আরও পড়ুনঃ  পোশাক কারখানা চালু, অসংখ্য মানুষ ঢুকছে ঢাকায়

নিজস্ব অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি :
আব্দুল খালেক তার বাড়িতে নিজ অর্থায়নে একটি জাদুঘর তৈরি করেছেন। যেখানে সযতেœ রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় নিদর্শন। টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিদর্শন সংগ্রহ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রেখেছেন তার গ্রামের ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধার ছবি। আব্দুল খালেক বলেন, পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের ইতিহাস জানাতে তার এই উদ্যোগ। তার জন্য একটি ঘর বরাদ্ধ দিয়েছে সমাজসেবা বিভাগ। তিনি ঘরের পরিবর্তে তার মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক জাদুঘরটিকে সংস্কার করাসহ আঞ্চলিক জাদুঘরে রুপান্তর করার দাবি জানান।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন