ঢাকা | মঙ্গলবার
৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কেঁচো সার উৎপাদনে সফল মামুন

কেঁচো সার উৎপাদনে সফল মামুন

প্রকৌশলীর পরিবারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় কেঁচো সার উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন মামুনুর রশীদ মামুন নামে এক যুবক। উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের এ তরুণ অল্পপুঁজি কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছেন। মাত্র চার হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা মামুনের খামারে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭২ টন।

সারেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্বপরিবারে খামারে কাজ করছেন মামুন। তিনি জানান, শিক্ষা জীবনে তিনি কুড়িগ্রামের একটি বেসরকারি ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছেন। এরপর ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে চাকুরি করেন। ২০২০ সালের শুরুতেই পারিবারিক সমস্যার কারণে চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে তার উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে জৈবকৃষি বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘অদম্য কৃষি’র পরামর্শে একটি পরিত্যক্ত ঘরে কেঁচোর খামার শুরু করেন তিনি। শুরুতেই তিনি মাত্র চার হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৬টি রিং এবং রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে আনা ১.৫ কেজি কেঁচো দিয়ে উৎপাদন শুরু করেন। খামারের নাম দেন ক্রিয়েশনস্। পাশাপাশি ফেসবুকের মাধ্যমে তার নিজস্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশনস্ বিজনেস’র অনলাইন মার্কেটিং শুরু করেন।

বর্তমানে তিনি সেই খামারেই ২৪টি রিং বসিয়েছেন এবং আরো ১০ শতক জায়গায় নতুন শেড তৈরি করেছেন। সেখানেও বসিয়েছেন ৩৬টি রিং। বাকি জায়গায় স্তুপ প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করছেন কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মিকম্পোস্ট।

দুই খামার মিলে প্রতিমাসে প্রায় ৬টন জৈবসার উৎপাদন করেন বলে জানান তিনি। উৎপাদনশীলতার দিক থেকে এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলার সবচেয়ে বড় কেঁচো খামার ক্রিয়েশনস্ কেঁচো খামার নামের এ প্রতিষ্ঠানটি।

ভার্মিকম্পোস্ট তৈরী করতে তিনি গ্যাসমুক্তবাসী গোবর, কলাগাছ কুচি ও কেঁচো ব্যবহার করে থাকেন। মামুন বলেন, অত্যন্ত উপকারী হওয়ায় এ সারের চাহিদা প্রচুর। দ্রæত বিক্রি হয়। স্টক করে রাখার প্রয়োজন হয় না। প্রতি কেজি কেঁচো সার খুচরা ২০-২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পাইকারি ১০-১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এ কেঁচো সার।

তিনি আরও বলেন, সার বিক্রি করে প্রতিমাসে আমার প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। এছাড়া কেঁচোও বিক্রি হয়। এখন আগের থেকে ভালো অবস্থানে আছি। আমার আর ঢাকায় গিয়ে চাকরি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
ছেলের সাফল্য নিয়ে কথা হয় মামুনের মা মর্জিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, একসময় খুবই অসহায় জীবন যাপন করেছি। তারপর ছেলে কেঁচোর খামার শুরু করে। এখন খামারের আয় দিয়েই সংসার চলে।

মামুনের বড় বোন শারমিন আক্তার নিজেও একজন উদ্দ্যোক্তা। অন্যের জমি লিজ নিয়ে গাছের চারা উৎপাদন করেন। তিনি জানান, মামুনের কাছ থেকে কেঁচো সার কিনে নার্সারিতে ব্যবহার করছি। এ সার ব্যবহার করে সুস্থ ও রোগব্যাধিমুক্ত চারা উৎপাদন করছি।

স্থানীয় সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী রাশিদুল ইসলাম জানান, মামুনের খামার থেকে ভার্মিকম্পোস্ট কিনে বিক্রি করি। এ সার সবধরনের ফসলে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধানক্ষেতে এ সার দিলে রাসায়নিক সার কম ব্যবহার করলেই চলে। তাই এ সারের অনেক চাহিদা রয়েছে।

মামুন জানান, ২০১৬ সালে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী পালন, প্রাথমিক চিকিৎসা, মৎস্য চাষ ও কৃষি বিষয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে তিনমাসের প্রশিক্ষণ নেই। সেখানে ভার্মিকম্পোস্টসহ বিভিন্ন ধরনের জৈব সার তৈরীর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২০ সালে অদম্য কৃষি থেকে এই কাজ করার পরামর্শ নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদক এসোসিয়েশন ও নিজের বলার মত একটা গল্প ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমি এ সারের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজার তৈরি এবং বাজারজাতকরণ সংশ্লিষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি।

এ বিষয়ে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মনজুর আলম বলেন, আমি তার খামার পরিদর্শন করেছি। সে কেঁচো সার উৎপাদন করছে। কেঁচো সার উৎপাদনে তার সফলতা আশপাশের যুবকদের উদ্যমী হতে অনুপ্রাণিত করবে।

উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, এ সারটি আসলে মাটির প্রাণ। বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে এ সারের বিকল্প নেই। আমি কৃষি বিভাগ থেকে সর্বদা তার পাশে আছি। সবসময় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তার উৎপাদিত কেঁচো সার কিভাবে সঠিকভাবে বাজারজাত করা যায়, কিভাবে তাকে আরও লাভবান করা যায়, আমরা সেই পরিকল্পনা করছি।

উল্লেখ্য, গত ২৮ অক্টোবর ২০২১ ইং তারিখে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আয়োজিত মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে শত কৃষকের সম্মাননা অনুষ্ঠানে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনে সফলতার জন্য মামুনুর রশিদ মামুনকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।

আনন্দবাজার/এম.আর

সংবাদটি শেয়ার করুন