সেফহোম। যেখানের বাতাসের ভেসে বেড়ায় বেদনার সুর। অনাথ, নিপীড়িত হয়ে সেফহোমে থাকা শিশু ও নারীগুলোর দীর্ঘশ্বাসের নিরব বেদনা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। ধীরে ধীরে বন্দিদশা জীবন তাদের কাছে ক্লান্ত হয়ে উঠে। ক্লান্তিময় জীবনটা প্রতিদিনই কাটে একইমতো। তবে শুক্রবার, রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া সেফহোমের পরিবেশটা ছিল ভিন্ন। বাতাসে ছিল মিলনের সুর। ক্লান্ত জীবনের দিগন্তে ফুটে উঠেছিল নতুন স্বপ্নসূর্য।
বন্দীদশা থেকে অন্তরা ও শিরিনা সংসার জীবনে পা দিলেন। অন্তরা বেগম ফজিলা আর শিরিনা খাতুনের কোন অভিভাবক নেই। রাজশাহীতে দুজনেই ছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতীদের নিরাপদ আবাসনে (সেফহোম)। দুজনেরই বয়স হয়েছিল ৩৩। শুক্রবার তাদের বিয়ে দেয়া হয়েছে। পবা উপজেলার বায়ায় এ সেফহোমে অনেকটা ধূমধামেই বিয়ের আয়োজন হয়।
এই বিয়েতে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল ও পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লসমী চাকমা ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রায় এক যুগ আগে আদালতের আদেশে রাজশাহী পবার সেফ হোমে ঠাঁই হয়েছিল তাদের। সেখান থেকে নতুন জীবনের নতুন স্বপ্ন ধরা দিলো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায়। গায়ে হলুদসহ অনুষ্ঠানের কোথাওই জৌলুশের কমতি ছিলো না। এক পিঁড়িতে দুজনের বিয়ের মধ্য দিয়ে আজ বাইরের মুক্ত দুনিয়ায় পা রাখলো শিরিন ও অন্তরা।
দুই বরের পক্ষ থেকে বরযাত্রী এসেছিলেন আরও প্রায় ৪০ জন। অন্তরাকে বিয়ে করেছেন রাজশাহী নগরীর বড়বনগ্রাম দুরুলের মোড় এলাকার মো. বিপ্লব (৪২)। আর শিরিনাকে বিয়ে করেছেন পবার পিল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন (৫০)। দুজনেরই স্ত্রী মারা যাওয়ায় পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করলেন। দুজনেরই বিয়ের দেনমোহর করা হয়েছে এক লাখ টাকা।
শুক্রবার দুপুরে সেফহোমে প্রবেশ করে দেখা যায়, বরদের জন্য একটি গেট বানানো হয়েছে। পাশেই একজন বসে অতিথিদের আনা উপহারসামগ্রী গ্রহণ করছিলেন। একটু সামনে এগিয়ে যেতেই দুই কনের গায়ে হলুদের প্যান্ডেল। সেখানেই বসেছিলেন বিপ্লব আর ইসমাইল। ডিসি-এসপির সামনে মুখে রুমাল দিয়ে বসেছিলেন দুই বর।
অন্তরার স্বামী বিপ্লব জানান, কয়েকবছর আগে দুই ছেলেমেয়েকে রেখে তার স্ত্রী মারা যান। তাই তিনি সবার সম্মতিতে এ বিয়ে করছেন। বিপ্লবের সঙ্গে তার ছেলেমেয়েও এসেছিল। বিপ্লব একজন ব্যবসায়ী। আর শিরিনার স্বামী ইসমাইল হোসেন অটোরিকশার চালক। তারও স্ত্রী মারা গেছেন। ইসমাইলের সঙ্গে এসেছিলেন তার বেয়াই, ভাগনে, দুই পূত্রবধূ, নাতি-নাতনিসহ ১৫ জন। বিয়ের জন্য ইসমাইল হাতে মেহেদি দিয়ে এসেছিলেন। আর দুই বরই পরে এসেছিলেন একই রঙের পাঞ্জাবী।
বর ইসমাইল হোসেন জানান, ঘটকের মাধ্যমে এ বিয়ে লেগেছে। বিয়ের আগে তিনি এসে পাত্রী দেখে গেছেন। তার পাত্রী পছন্দ হয়েছে।
ইসমাইলের দুই পূত্রবধূ জয়া বেগম ও দিলরুবা বেগম জানালেন, শ্বশুরের এ বিয়েতে তারা খুব খুশি। এ বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য সেফহোমেই ৪৫ কেজি খাসির মাংস, ৫৫ কেজি মুরগির রোস্ট, ২০ কেজি মাছ, ২২ কেজি পোলাও চাল রান্না করা হয়। সাদাভাত, ডাল, মিষ্টি এবং দইয়েরও ব্যবস্থা ছিল। সেফহোমের পক্ষ থেকেই এ সব আয়োজন করা হয়। বিয়ের পর রাজশাহী জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আমন্ত্রিত অতিথিসহ বরযাত্রীরা এ খাবার খান।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, অভিভাবকহীন দুই নারীকে পারিবারিক বন্ধনে দিতে পেরে আমার ভাল লাগছে। বিয়েতে নিজেরা খুশি বলে জানিয়েছেন অন্তরা-শিরিনাও।
সেফহোমের উপ-তত্বাবধায়ক লাইজু রাজ্জাক জানান, অভিভাবকহীন এ দুই নারীকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পঞ্চগড়ের একটি আদালত ২০১০ সালে অন্তরাকে এ সেফহোমে পাঠান। একই বছর শিরিনাকে সেফহোমে পাঠান রংপুরের আদালত। তাদের বিয়ের প্রস্তাব এলে সংশ্লিষ্ট আদালতের অনুমতি নেয়া হয়। এরপরই বিয়ের আয়োজন করা হয়। দুই নারীর বিয়ে দিতে পেরে তিনিও খুশি।
২০১০ সালে রংপুর আদালতের আদেশে শিরিনা খাতুন ও পঞ্চগড় আদালত এর আদেশে ফজিলা খাতুন অন্তরাকে নিয়ে আসা হয় রাজশাহীর পবার সেফ হোমে। এরপর সেখানে কেটেছে ১১ বছর, নিয়েছেন নানা বিষয়ে প্রশিক্ষন। প্রতিষ্ঠানই তাদের পিতা-মা’র বাড়ি। সেখানে থেকে কণে সেজে তারা গেলেন শশুরবাড়ি।
আনন্দবাজার/এম.আর