- তিস্তায় নৌকাডুবির ২৬ বছর
১৯৯৫ সালের ১১ নভেম্বর। রিলিফের গম নিতে যাওয়ার সময় রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তায় নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন চরাঞ্চলের ৩৩ জন অভাবি মানুষ। ঘটনার ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও কেউই খবর নেয়নি তাদের। এমনকি কারো কাছ থেকে শান্তনাটুকুও জোটেনি দূর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের ভাগ্যে।
জানা যায়, ওই সময় আর্শ্বিন-কার্তিক মাসে কাজ না থাকায় অভাবে পড়তো উত্তরাঞ্চলের শ্রমজীবী পরিবারগুলো। একটা সময় এ অভাব প্রকট আকার ধারন করতো। মানুষজন হয়ে যেত দিশেহারা। ১৯৯৫ সালে এমনি এক সময় গঙ্গাচড়ার তিস্তাপারের লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরাঞ্চলের মানুষ জানতে পারে ইউনিয়ন পরিষদে রিলিফের গম বিতরণের খবর।
ঘটনার দিন ১১ নভেম্বর সকালে জয়রামওঝা ও ইশোরকোল চরের শতাধিক পরিবারের মানুষ কানকাটা ঘাট থেকে নৌকায় করে রওনা দেন মহিপুর হাটে অবস্থিত লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের উদ্দেশ্যে। শুকনা মৌসুম হলেও হঠাৎ উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে প্রায় ১৫০ যাত্রী নিয়ে মাঝ নদীতে ডুবে যায় তাদের বহন করা নৌকাটি। সে সময় অভাবি এ মানুষগুলোর আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। অনেকে নদী সাঁতরে উঠে আসলেও নারী ও শিশুসহ ৩৩ জনের প্রাণহানি ঘটে।
ওই ঘটনায় নিহতরা হলেন, জহিরা খাতুন, মানিকা, মোজা মিয়া, জমিলা, দলিমুদ্দিন, আনছার আলী, মেনার উদ্দিন, রমজান আলী, আবজন, রেয়াজুল, সেকেন্দার, মনছুর আলী, আব্দুল জলিল, নওশা মিয়া, ছয়ফল, জাহেরা, হাছেন বানু, এয়াজুল, জমিলা, ইসলাম, আব্দুর রউফ, বয়েজ উদ্দিন, খলিল, গোলাপ, ছকো মিয়া, ময়জুন্নেছা, ছফিয়া, আলেপজন, মর্জিনা, আরফিনা, রবিউল, মতিজুল, ও মনছুর বাদ্যকর। এদের অনেকের লাশ উদ্ধার করা হলেও কারো কারো সন্ধান মেলেনি।
২৬ বছরের মাথায় নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত পরিবারগুলোর অবস্থা জানতে চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, আজও অভাব তাঁদের পিছু ছাড়েনি। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে তাদের। দু’একজনের ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ড জুটলেও অনেকের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। স্বজন হারানোর শোকে গত কয়েক বছরে মারাও গেছেন কেউ কেউ।
চর ইশোরকোল গ্রামের আমজাদ হোসেন নৌকাডুবির কথা তুলতেই হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, ওই সময় তিনি এলাকায় কাজ না থাকায় সিলেটে গিয়ে রিকসা চালাতেন। ১৫ দিন পর বাড়ি ফিরে জানতে পারেন, নৌকাডুবিতে তাঁর স্ত্রী মর্জিনা বেগম ও এক বছরের শিশু কন্যা আরফিনা মারা গেছে। তাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রিয়জনের কবরে এক মুঠো মাটি দিতে না পারায় কষ্ট এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
জয়রামওঝা চরের মিজানুরের বয়স এখন ২৮ বছর। দুই বছর বয়সে ভয়াবহ এ নৌকা ডুবিতে বাবা আবদুল জলিলকে হারিয়েছেন। তখন থেকে মা মোর্শেদার সাথে নানা বাড়িতে বড় হয়েছেন তিনি। মিজানুর বলেন, বাবাকে মনে নেই, তবে মায়ের কান্নায় বড় কষ্ট হয়। ছেলে মতিজুলকে হারিয়ে মতিবর হয়েছেন মতি পাগলা। ইশারায় সেই ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। স্বামী গোলাপ মিয়াকে হারিয়ে বিধবা মনোয়ারা ঠাঁই নিয়েছেন একমাত্র সন্তানকে নিয়ে চর ইশোরকোল আশ্রয়ণ কেন্দ্রে। তিনি বলেন, ওই ঘটনার পর থেকে বড় কষ্টে আছি।
নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত জয়রামওঝা চরের দলিমুদ্দিনের স্ত্রী শাহানা ও ইসলামের স্ত্রী মোমেনা জীবন বাঁচানোর তাগিদে এখন ভিক্ষা করেন। তাঁদের এ পরিণতির জন্য তিস্তাকে অভিশাপ করেন তারা। আক্ষেপ করে তাঁরা বলেন, তিস্তাই হামার জীবনটাকে ওলোট-পালোট করি দিছে। গত ২৬ বছরে কায়ও হামাক শান্তনা দিবার আইসে নাই।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, রিলিফ নিতে গিয়ে নৌকাডুবির ভয়াল সেই স্মৃতি গঙ্গাচড়ার তিস্তাকুলবর্তী মানুষকে আজও কাঁদায়। তখন থেকেই নিহত ওই পরিবারগুলোর আষ্টে-পৃষ্ঠে লেগে আছে অভাব। সরকারি কোন সাহায্য-সহযোগিতা পেলে ওই পরিবারগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
প্রতি বছরের মত গত ১১ নভেম্বর ইশোরকোল ও জয়রামওঝা চরে নৌকাডুবির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো নিহতদের স্মরণে সামর্থ্য অনুযায়ী দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে।
আনন্দবাজার/শহক