রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মৃত্যু আলিঙ্গন করে বাঁচতে হয় মান্তা শিশুদের

চারদিকে পানি আর পানি, মাঝখানে নাও। এরই মধ্যে এদের বসবাস। জন্ম মৃত্যু, বিয়ে, খাওয়া, নাওয়া সবই এ নাওয়ের মধ্যে। এখানে সন্তান জন্মদেয়া ও লালন-পালন। এরা মান্তা সম্প্রদায়। মান্তা শিশুদের তাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাঁচতে হয়। পেশার টানে অভিভাবকরা যখন জাল নৌকা নিয়ে ব্যস্ত তখন শিশুরা হয়ে পড়ে একা।

চারদিকে পানি আর পানি, মাঝখানে নাও। এরই মধ্যে এদের বসবাস। জন্ম মৃত্যু, বিয়ে, খাওয়া, নাওয়া সবই এ নাওয়ের মধ্যে। এখানে সন্তান জন্মদেয়া ও লালন-পালন। এরা মান্তা সম্প্রদায়। মান্তা শিশুদের তাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাঁচতে হয়। পেশার টানে অভিভাবকরা যখন জাল নৌকা নিয়ে ব্যস্ত তখন শিশুরা হয়ে পড়ে একা।

অনেক সময় এ শিশুরা খেলতে গিয়ে নাও (ছোট নৌকা) থেকে পানিতে পড়ে যায়। আবার কেউ পানির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচেও যায়। মান্তা শিশুদের সবারই পানিতে পড়ে যাওয়া স্মৃতির কমবেশি রয়েছে। পটুয়াখালী, বাউফল, মির্জাগঞ্জ, দুমকি, গলাচিপা, দশমিনা, কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালীসহ বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোতে প্রায় ৫ হাজার মান্তা পরিবারের বসবাস। প্রতিটি নৌকায় নবজাতকসহ ১ থেকে ৫ বছরের ১টি কিংবা ২টি শিশু রয়েছে। এ বয়সের সব শিশুকেই কোমরে রশি দিয়ে নৌকার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।

নৌকা থেকে স্থলে কখনও তুলে আনা হলে শিশুদের কোমরেই মোড়ানো থাকে রশি। তাদেরই একজন আলগী নদীর মনসুর সরদারের মেয়ে শাবনুর। ৩ বছরে শাবনুর নদীতে পড়েছে ১০ বার। মা চানবানু জানান, জন্মের ছয় মাস পর থেকেই ওকে নৌকার সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। কিন্তু অনেক সময় মনে না থাকায় রশি বাঁধা হয়নি। তখনই শিশুটির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। তবে প্রতিবারই ভাগ্যগুণে শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

আনছার সরদারের চার বছরের ছেলে লাল মিয়া পানিতে পড়েছে ৮বার। সবশেষ দুই মাস আগে শিশু লাল মিয়া যখন পানিতে পড়ে ডুবে যায় তখন দীর্ঘ খোঁজাখুজিতেও সন্ধান মেলেনি। এক পর্যায়ে সালমা খাতুনের জালে আটকা পড়ে শিশু লাল মিয়া। জীবন যাত্রায় শেষবারও বেঁচে যায় এ শিশুটি। এভাবে পানির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে গেছে শমসের সরদারের মেয়ে শাহানাজ (৪), বাচ্চু সরদারের ছেলে সোহেল (৩)। শিশু সোহেলকে ভাসমান অবস্থায় উঠানো হয় নদী থেকে। অভিভাবকরা ধরেই নিয়েছিলেন সোহেল আর বেঁচে নেই। পরে দশমিনা বাজারে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হলে শিশুটি সুস্থ হয়ে ওঠে। একই বহরের শাহীন (৪), মুছা (৪), রাবিয়া(৩) ও মুন্নি (৪)। মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে কয়েক দফা জোয়ার-ভাটার পানিতে পড়ে নিয়তির ইচ্ছায় বেঁচে ফিরেন।

আরও পড়ুনঃ  মোংলায় খালাস হচ্ছে রূপপুরের পরমাণু চুল্লিপাত্র

আবার অনেক শিশুকে মৃত্যু নামক কর্মটি ঘুম পাড়িয়ে দেয় তেঁতুলিয়ার পানির কোলে। তাদের একজন সাহেব আলী ও রোজিনার দু’বছর ৭ মাসের সন্তান রুবেল। এ বয়সে শিশুটি দু’বার পানির সঙ্গে লড়াই করেছিলো। অবশেষে ৩ মাস আগে শিশু রুবেল পানির ডাকে আর টিকতে পারেনি। অকালে আলিঙ্গন করতে হয়েছে মৃত্যুকে। সাহেব আলী আর রোজিনার মত অনেক মান্তা সম্প্রদায়ের পিতা-মাতা অকালে সন্তান হারানোর বেদনায় কাতর। ৫ থেকে ৬ বছর বয়সে পড়লেই এ সব শিশুরা সাঁতার শিখে। তখন ওদের এ মৃত্যু ঝুঁকি থাকে না। অভিভাবকরাও হয় তখন চিন্তা মুক্ত।

মান্তা পরিবারের আলেয়া বেগম (৩০) বলেন, আমাগো গুরাগ্যারা অওয়ার পর ৫ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত কোলে কোলে রাহি, এতে কাম করতে অসুবিধা অয়। পরে দরি দিয়া নাও এর লগে বাইন্দা থুই, মনে না থাকলে অনেক সময় খোলা থাহে হেইকালে পানিতে পড়ইগ্যা যায়। ছোড কাল অইতে আমাগো গুরাগ্যারাগুলা মরণ দ্যাখতে দ্যাখতে বড় অয়। সরকারের ব্যামালা জাগাজমি, আমাগোরে তরে ঘর বানাইয়া দেলে আমাগো গুরাগ্যারা মরতে মরতে বড় অইতে না।

শুধু মান্তা নয়। চরের শিশুরাও মৃুত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। কারণ বেঁড়ি বাঁধ না থাকা, আদৌ রাস্তাঘাটের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া এবং চিকিৎসার অভাবে গলাচিপা, দশমিনা, কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী ও বাউফল চরাঞ্চলের শিশুরা প্রতিমুহুর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। প্রকৃতির অভিশাপ- ঝড়, বন্যা কিংবা জলচ্ছ¡াস চরাঞ্চলের শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া চিকিৎসা না পেয়ে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার সময় অসংখ্য চরের শিশু খুব সহজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।

আরও পড়ুনঃ  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদত্যাগ

তবে ভাগ্যগুনে বেঁচে যায় ওরা। তাদেরই একজন কাজল রেখা। বয়স দু’বছর ছয় মাস। বাউফলের চর ব্যারেটে ওর বসবাস। হাঁটা শুরু পর কাজল এ পর্যন্ত ৪ বার পানিতে পড়েছে। প্রতিবারই ভাগ্যগুণে বেঁচে যান। মা রুমা বেগম বলেন, হায়াত আছে এই লইগ্যা আল্লায় অরে হালাইয়া থুইয়া গ্যাছে। এ চরে বচ্ছরে পানিতে পইর‌্যা যে কত গুরাগ্যারা মরে হ্যার কোন অন্ত নাই। রুমার একমাত্র সন্তান কাজল রেখা ৮ মাস বয়সে প্রথম পানিতে পড়ে। অনেক খোঁজাখুজির পর ঘরের পাশের বাঁধ দেয়া খাল থেকে জাল মেরে উঠানো হয় অর্ধ মৃত অবস্থায়। এভাবে চারবার শিশুটি মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ে। ২য় বার পানিতে পড়ার পর থেকে শিশুটির গলায় বাবা আফজাল খা ক্রমান্বয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন ৩টি তাবিজ। তার বিশ্বাস এখন আর তার সন্তান পানিতে পড়বে না। তাছাড়া পনিতে পড়ার কারণে শিশুটি অনেক ভয় পেয়েছে এবং জ্বিন পরীর আছর থাকতে পারে তাই তাবিজ ঝুলানো হয়েছে গলায়।

অনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন