ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিবেশ সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগে সেরা কুমিল্লার মতিন সৈকত

পরিবেশ সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগে সেরা কুমিল্লার মতিন সৈকত

পরিবেশ সংরক্ষণে বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রাম বিভাগে টানা পঞ্চমবার সেরা নির্বাচিত হয়েছেন কুমিল্লার মতিন সৈকত। আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে তিনটি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাটাগরিতে তিনটি মিলিয়ে সরকারিভাবে মোট ৬টি জাতীয় পরিবেশ পদক প্রদান করা হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে শীর্ষস্থান অর্জনকারীদের মধ্যে থেকে ৩ জনকে জাতীয় পরিবেশ পদক প্রদান করা হয়।

সরেজমিনে পরিদর্শন এবং দীর্ঘ যাচাই বাছাই শেষে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে মতিন সৈকত-কে নির্বাচিত করে জাতীয় পরিবেশ পদকের জন্য জাতীয় কমিটি বরাবর সুপারিশ করা হয়। জাতীয় পরিবেশ পদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় মূল্যায়ন কমিটির সভা সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এর আগে ২০১৫, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ সালেও মতিন সৈকত চট্টগ্রাম বিভাগে শীর্ষ স্থান অর্জন করে একাধিকবার জাতীয় পরিবেশ পদকের জন্য প্যানেলভূক্ত হয়েছেন।

পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ব্যবহার ও সম্প্রসারণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকে ভূষিত করেন। সৃজনশীল কাজের জন্য তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন পত্র পেয়েছেন। কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের মতিন সৈকত একজন বহুমুখী সমাজকর্মী, সৃজনশীল শিক্ষক ও পরিবেশ যোদ্ধা। তার গ্রাম আদমপুর এবং পুটিয়া ও সিঙ্গুলা তিন গ্রামের মধ্যবর্তী ১৫০ বিঘা বোরোধানের জমিতে ২৬ বছর যাবত মাত্র দুইশ টাকা বিঘাপ্রতি মৌসুমব্যাপি সেচের পানি সরবরাহ করে ধান উৎপাদনে সহযোগিতা করে জাতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শুধু মাত্র বিদ্যুৎ বিলের বিনিময়ে ২০০০ সাল থেকে আপুসি মৎস্য প্রকল্পে পানি সরবরাহ করে আসছেন।

এছাড়াও মতিন সৈকত প্রত্যেক বছর বোরোধানের জমিতে ঝাটা-জিংলা পুতে দেন যাতে পাখি বসে পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে নিরাপদ রাখে। এতে কোন ধরনের কীটনাশক বা বিষ ব্যাবহার করা লাগেনা। বিষ, মাটি, পানি, বাতাস, ফসল ও অর্থ নষ্টের পাশাপাশি জনস্বাস্থের ক্ষতি করে। মতিন সৈকত ফসলের মৌসুমে ঢোল পিটিয়ে মাইকিং করে এলাকার কৃষকদের কীটনাশক বা বিষের ভয়াবহ ক্ষতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করেন। তাছাড়াও সেচের উৎস কালাডুমুর নদ মতিন সৈকতের উদ্যোগে ১১ কিলোমিটার পূনঃখনন হয়েছে।” একমাত্র ফসল বোরোধান উৎপাদনের পরে এখানকার প্লাবনভূমির জমিগুলো বর্ষায় অলস অনাবাদি পরিত্যক্ত থাকত। ঘাস, কচুরিপানা, আবর্জনা জমে জঞ্জাল তৈরি হত। পরিস্কার করতে বিঘাপ্রতি ৪/৫ হাজার টাকা লাগত।

বেকারত্ব, সামাজিক অবক্ষয়রোধে কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গণশেয়ারের ভিত্তিতে স্হানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সমাজ ভিত্তিক আদমপুর, পুটিয়া, সিংগুলা তিন গ্রামের মধ্যবর্তী ২৫০ বিঘা জমিতে আপুসি এবং পুটিয়াতে ১০০বিঘা জমিতে বিসমিল্লাহ, আদমপুর, পুটিয়া, বিটমান তিন গ্রামের মাঝখানে ৩৫০বিঘা জমিতে আপুবি মৎস্য চাষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। এসব প্রকল্পে প্রতি বছর পরিবেশ সম্মত মাছ চাষ করে কয়েক কোটি টাকার মাছ উৎপাদন করা হয়। স্হানীয় জনগণের ব্যাবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থ ও পুষ্টির চাহিদা পুরণ হচ্ছে। বেড়িবাঁধ তৈরি করে নতুন নতুন রাস্তা বানানোর ফলে সেখানে গাছ লাগিয়ে পরিবেশের উন্নয়ন হচ্ছে। বোরোধান উৎপাদনে খরচ কমানোর সাথে বর্ষায় অনাবাদি জমিতে মাছ চাষ করার ফলে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। বিঘাপ্রতি ১৪/১৫ হাজার টাকা করে প্রতি বছর জমিনের ভাড়া বাবদ পাচ্ছেন।

বাংলাদেশে মাত্র ১০টি ইউনিয়নকে সরকারিভাবে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। পরিবেশ বান্ধব কৌশল অবলম্বনে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে মতিন সৈকতের ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়ন আইপিএম মডেল ইউনিয়নের মর্যাদা পেয়েছে। মতিন সৈকত তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিষমুক্ত ফসল, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, মাত্র দুইশ টাকা বিঘাপ্রতি বোরোধান মৌসুমব্যাপি ২৬ বছর যাবত সেচ সুবিধা প্রদান, খাল-নদী পূনঃখনন, কালাডুমুর নদের ১১ কিলোমিটার পূনঃখনন, প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণীর পাশাপাশি এক হাজারের বেশি পাখি উদ্ধার ও অবমুক্ত করণ, সবুজায়ন আন্দোলন, নার্সারি প্রতিষ্ঠা, মহাসড়কের পাশের এবং শহর নগরের ময়লা আবর্জনাকে থেকে সিটিজেন ফার্টিলাইজার প্রক্রিয়াকরণসহ বহুমুখী পরিবেশ উন্নয়নে সামাজিক আন্দোলনে নিরন্তর নেতৃত্ব দিয়ে চলছেন। ‘অব দ্যা বেটেনটেক দি ক্রপ ক্রুসেডার, এরিয়েল প্রেট্রিয়ট, এম্যান টুবিফলোইড, এন লাইটেড মতিন সৈকত, মতিন সৈকত এরিয়েল ফ্রেন্ড অব ফারমার্স ইন কুমিল্লা শিরোনামে অভিহিত হয়েছেন। প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যাক্তিত্ত রামেন্দু মজুমদার, শাইখ সিরাজ, মুন্নী সাহা, প্রভাষ আমিন, রেজাউল করিম সিদ্দিক, দেওয়ান সিরাজ, রোম্মান রশিদ-সাদিয়া ওহাব তাকে নিয়ে টেলিভিশনে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান করেন। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি তার কাজের ডকুমেন্টারি প্রচার করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফ, এ ও, – ডি, এফ, আই, ডি, — ইউ এন ভলন্টিয়ার্স এবং কানাডা বাংলাদেশ সেন্টার তার কাজের প্রশংসা করেছেন।

দাউদকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সারোয়ার জামান বলেন ‘আদমপুর গ্রামের শিক্ষক পরিবেশ যোদ্ধা মতিন সৈকত উপজেলার কৃষকদের খুব আপনজন। সরকারের পাশাপাশি তৃণমূলে কৃষকের পাশে থেকে সব সময় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। তিনি ২৬ বছর ধরে নাম মাত্র মূল্যে মাত্র দুইশ টাকায় বিঘাপ্রতি সেচ ব্যবস্থা করে কৃষকদের সেবা দিয়ে আসছেন। তিনি কৃষকদের যেভাবে সংগঠিত করে তাদের সহযোগিতা করছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।’

আনন্দবাজার/শাহী/আলাউদ্দিন

সংবাদটি শেয়ার করুন