ঢাকা | রবিবার
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দপুরে ইটভাটার গ্যাসে কোটি টাকার ৭টি বাঁশঝাড় ভস্মিভূত

নীলফামারীর সৈয়দপুরে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের ৭টি বাঁশঝাড়ের ৭ হাজার জীবন্ত বাঁশ ভস্মিভূত হয়েছে। ঝলসে গেছে একটি পটল ক্ষেতসহ আশেপাশের ২৫ টি বিভিন্ন ফলগাছ। দুুইদিন আগে ধান কেটে নেয়ায় ভয়াবহ ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে শতাধিক কৃষক। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের কুজিপুকুর আদর্শ গ্রামে।

ওই গ্রামের মৃত তছলিম উদ্দিনের ছেলে আদর্শ কৃষক মোঃ শফিকুল ইসলাম (৪৫) বলেন, গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে রাস্তার দুইপাশে প্রায় ১ একর জুমি জুড়ে তাদের পৈত্রিক তিনটি বিশালাকৃতির বাঁশঝাড়। এই বাঁশঝাড়ে প্রায় ৫ হাজার বিক্রয়যোগ্য বাঁশ আছে। মোট বাঁশের মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। প্রতিটি মাখলা বাঁশ ২শ’ থেকে ২শ’ ৫০ টাকা দরে প্রতিবছর তিনি দেড় থেকে ২ লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি করেন।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সুজলা সবুজ আমার ওই বাঁশঝাড়টি হঠাৎ করে গত শুক্রবার বিকালে দেখি সবগুলো পাতাই হলুদ ও লালচে বরণ ধারণ করেছে। শনিবার বিকাল থেকে সব বাঁশের পাতা অস্বাভাবিক পরিমানে ঝরতে থাকে এবং রবিবার বিকাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক পাতাই ঝরে পড়েছে।

এমন আকস্মিক ঘটনায় প্রথমে ভেবেছিলাম বজ্র্যপাতের কারণে এ পরিস্থিতি হয়েছে। কিন্তু ক্রমেই জানতে পাড়ি আশেপাশের আরও ২ জনের বাঁশঝাড়, ১ জনের পটল ক্ষেত ও কয়েকজনের বিভিন্ন ফলগাছও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কৃষি অফিসসহ অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

এমতাবস্থায় এলাকাবাসীর মাধ্যমে জানলাম যে, গত শুক্রবার সকালে পূর্বদিকে অবস্থিত মেসার্স এমএইচবি ইটভাটার চলতি মৌসুমের জ্বলন্ত আগুন নেভানো হয়েছে। এসময় আগুন নেভানোতে ব্যবহৃত রাসায়নিক তেলের প্রভাবে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে তা ভাটার চিমনি দিয়ে নির্গত হয়ে বাতাসের পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এই বিষাক্ত গ্যাস যেখান গিয়ে গাছ বা মাটির সংস্পর্শে এসেছে সেখানেই ঝলসে গেছে।

একই অভিযোগ করেন মৃত বাতাসু মামুদের ছেলে মজিবর রহমান (৬৭)। তার ৪ শতক জমির বাঁশঝাড়ও ভস্মিভূত হয়েছে। তার ভাই নুর হোসেনের ৬ শতক জমির অপর একটি বাঁশঝাড় এবং পশ্চিম দিকের মৃত সফির উদ্দিনের ছেলে লেবুর (৪৫) ১৫ শতক জমির বাঁশঝাড় ও একটি আমড়াগাছও ঝলসে গেছে।

সেইসাথে গেন্দু মামুদের ছেলে আব্দুল হামিদের ৬ শতক জমির বাঁশঝাড়,আংশিকভাবে পুড়ে গেছে। এছাড়া আদর্শ কৃষক মিলনের ৪৫ শতকের পটল ক্ষেত, নুর হোসেনের ছেলে আনারুলের একটি আমড়াগাছ, মেরিনা বেগমের উন্নত জাতের ৫টি সুপারি, ১০ টি পেয়ারা ও ৫ টি হাড়িভাঙ্গা আমের ফলন্ত গাছের পাতা ও ফল ঝলসে নষ্ট হয়ে গেছে।

শফিকুল ইসলাম বলেন বজ্র্যপাতের কারণে এ সমস্যা হলে এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন স্থানে ক্ষতি হতোনা। তাছাড়া গত মঙ্গলবার থেকে এলাকায় এমন কোন বড় ধরনের বজ্র্যপাতের ঘটনা ঘটেনি। এতে নিশ্চিত হই যে এটি ওই ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়া তথা গ্যাসের কারণেই হয়েছে। ফলে বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যান, কৃষি বিএস ও সাংবাদিকদের জানিয়েছি।

তাঁরা সোমবার (৩১ মে) সকাল ১১ টায় শফিকুল ইসলামের ডাকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে সাংবাদিকদের ইউনিয়ন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ডিপ্লোমা কৃষিবিদ মেরিনা বেগম বলেন, এটা অবশ্যই ইটভাটার ধোয়া বা গ্যাসের প্রভাবে হয়েছে। বিষয়টি ভাটা মালিকের সাথে কথা বলে সমাধান করতে হবে। যদি তারা ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমঝোতা হয় ভালো। নয়তো লিখিত অভিযোগ দিলে প্রশাসনিক কমিটি করে তদন্তের পর আইনানুগ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এসময় ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম লোকমান ঘটনার বিবরণ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ মুঠোফোনে ইটভাটা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে তারা প্রথমে দায় অস্বীকার করে ক্ষতিপূরণের দাবী নাকচ করে দেয়। পরে এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য সন্ধায় বসতে সম্মত হয়।

সাংবাদিকরা মুঠোফোনে মেসার্স এমএইচবি ইটভাটা মালিক মোঃ রাজু আহমেদ’র সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমার ভাটার কারনে গত ২৬ বছরে কারও কোন ক্ষতি হয়নি। এটাও ধোয়ার জন্য হয়নি। বাঁশঝাড় মালিকরা এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমিও ব্যবস্থা নিবো। প্রয়োজনে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করা হবে। তখন দোষী সাব্যস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দিবো। তার,আগে নয়।

উল্লেখ্য, মেসার্স এমএইচবি ইটভাটাটি এনালগ পদ্ধতির ফিক্সড চিমনি ধরনের। যা ২০১৩ সালেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। তারপরও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দীর্ঘদিন থেকে এ অবস্থাতেই চালু রাখা হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর মাসে পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী সচিবসহ রংপুর বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে ভাটা গুড়িয়ে দেয় এবং ৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে। সেসময় দ্রুততম সময়ে ডিজিটাল গ্যাসীয় পদ্ধতির ভাটায় উন্নীত করনের নির্দেশ দেয়। তার আগে যেন ভাটায় কার্যক্রম চালানো না হয় সে ব্যাপারেও সতর্ক করেন তাঁরা। সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে মান্ধাতার আমলের পুরাতন পদ্ধতিতেই চালানোর কারনেই এই দূর্ঘটনা ও ক্ষতি হলো বলে সবাই অভিযোগ করেছেন।

আনন্দবাজার/শাহী/মনন

সংবাদটি শেয়ার করুন