ঢাকা | মঙ্গলবার
১০ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গোমতীর চরের মাটি বিক্রি করে আয় হতে পারে কোটি টাকার রাজস্ব

কুমিল্লার প্রধান নদী গোমতীর চর এলাকার মাটি রাজস্ব আদায়ে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতি বছর উজান থেকে বিপুল পরিমান পলিমাটি নিয়ে নদীটির কুমিল্লা অংশে চরের উভয় পাশের তীর সমৃদ্ধ করলেও মাটি খেকোদের থাবায় সেটার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় কৃষকরা। ফলে জেলার অন্যতম শাক-সবজি উৎপাদনকারী এই চর এলাকার কৃষকরা যেমন অলস সময় পার করছে তেমনি অনেকটা লুটেরার মতো করে প্রভাবশালী চক্ররা যে যেভাবে পারছে চরের মাটি কেটে বিক্রি করছে অবাধে। স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে মাটি কাটা বন্ধে ভূমিকা রাখলেও কোনভাবেই মাটি কাটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। এমতাবস্থায় বালু মহাল ইজারার মতো চর এলাকা ইজারা দিয়ে মাটি কাটার বৈধতা দিলে সরকার এথেকে কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করার সম্ভাবনা রয়েছে।

গোমতী নদী ভারতের ত্রিপুরায় উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর নদীটি জেলার বুড়িচং, ব্রাহ্মনপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস হয়ে দাউদকান্দির টামটায় মেঘনা নদীতে মিলিত হয়। নদীটির দু’তীরে রয়েছে বিস্তীর্ণ চর। প্রতিবছর বর্ষায় উজান থেকে বিপুল পরিমান পলি মাটি নদীর দু’তীরের চরাঞ্চল উর্বর করে তোলে। আর এসব চরে কৃষকরা বারো মাস বিভিন্ন জাতের শাক-সবজি উৎপাদন করতো। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক পরিচয়ে জেলার বিভিন্নস্থানে প্রভাবশালী চক্র এস্কেভেটর বসিয়ে অবাধে মাটি কাটা শুরু করে। এতে খুব দ্রুততম সময়ে মাটি কাটা ও পরিবহনের সুবিধা হওয়ায় দিন দিন নদী তীরে এস্কেভেটরে মাটি কাটার পরিমান বাড়ছে। নদী তীরের একাধিকস্থানে কথা হয় একাধিক মাটি পরিবহনের সাথে জড়িত ডাম্প ট্রাক, ট্রাক্টর চালকদের সাথে। তারা জানান, এক ট্রাক্টর ১২’শ টাকা এবং প্রতি ডাম্প ট্রাক মাটি ২৫’শ টাকায় বিক্রি হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, নদী রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তারা নিরব। ফলে প্রতিদিন যত্রতত্র মাটি কেটে প্রতিরক্ষা বাঁধের ভিতর থেকে মাটি পরিবহনের ফলে বিভিন্নস্থানে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রতিরক্ষা বাঁধ। আবার এইসব ঝুঁকিপূর্ণস্থান প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড দরপত্র আহবান করে সংস্কার করে রাষ্ট্রের টাকায়। একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে জেলা প্রশাসন নদী থেকে মাটি কাটা বন্ধে কঠোর অবস্থান নিলেও কার্যত তার সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের ভেতর কিছু অসাধু লোক অভিযানের খবর সংশ্লিষ্ট এলাকার মাটিখেকোদের কাছে আগেই পৌঁছে দেওয়ায় বেশির ভাগ সময় অভিযানে গিয়ে শুণ্য হাতে ফিরে আসতে হচ্ছে প্রশাসনকে। এরকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সদর ও বুড়িচং এলাকায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সংবাদকর্মী জানান, কিছুদিন আগে বুড়িচংয়ের ময়নামতি মিরপুর এলাকায় চর থেকে মাটি কাটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলার সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে জানালে তিনি অন্য এক কর্মকর্তাকে ওই সংবাদকর্মীর মোবাইল নাম্বারটি দিয়ে দেন। তখন কর্মকর্তাটি ফোন করে প্রথমে তার নাম পরিচয় জানতে চায়, এরপর কোথায় মাটি কাটে এব্যাপারে নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। অথচ প্রতিদিন ওই মিরপুর এলাকা থেকে শত শত ডাম্পট্রাক মাটি বিভিন্নস্থানে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। একই অবস্থা অন্যান্য স্থানেও।

সরেজমিন ঘুরে বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, সদর উপজেলার ঝাঁকুনিপাড়া, টিক্কাচর, শ্যামারচর, শ্রীপুর, মাঝিগাছা, শালধর, চাঁন্দপুর, ছত্রখীল ,রত্নাবতী, কাপ্তানবাজার, ভাটপাড়া, পালপাড়া, আড়াইওরা, দুর্গাপুর, আমতলী, বুড়িচংয়ের বাবুবাজার, গোবিন্দপুর, পীরযাত্রাপুর, রামচন্দ্রপুর, মিরপুর, ফরিজপুর, ব্রাহ্মনপাড়ার মনোহরপুর, আসাদনগর, বৃষ্টিপুর, রামনগর , কালিকাপুর, অলুয়া , দেবিদ্বারের চরবাকর, জাফরগঞ্জ, ভিরেল্লা, ফতেহাবাদ, চাঁনপুর, লহ্মীপুর, বালু বাড়ি, হামলা বাড়ি, ভিংলা বাড়িসহ কমপক্ষে ২০/২২টি স্থানে বেপরোয়া মাটি কাটা চক্র সক্রিয় রয়েছে। নদীর চর এলাকার মাটি ব্যবসার সাথে জড়িত একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, তাদের মাটি ব্যবসা স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, হাইওয়ে পুলিশসহ তহসীল অফিসছাড়াও বিভিন্ন ঘাটে টাকা দিতে হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে- নদীর মালিকানা সরকারের, অথচ সেই নদীর চর এলাকা থেকে অবাধে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট মাটি কিভাবে বিক্রি হচ্ছে? জেলার পালপাড়া এলাকার একাধিক সুত্র জানায়, প্রশাসনের নজরদারী বেড়ে যাওয়ায় রাত বাড়ার সাথে সাথে মাটি কাটা শুরু হয়।

জেলা প্রশাসনের একটি সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতি বছর গোমতীর বিভিন্ন বালুর মহাল ইজারা দেওয়া হয়। এবছরও ইজারা হয়েছে অর্ধ কোটিরও বেশী টাকায়। এক্ষেত্রে গোমতীর চর এলাকাগুলো থেকে যে পরিমান মাটি বিক্রি করা হয় সেগুলো ইজারার মাধ্যমে হলে কোটি টাকারও বেশী রাজস্ব আদায় সম্ভব হতো। এতাবস্থায় মাটি বিক্রির জন্য গোমতীর চর এলাকা চিহ্নিত করে প্রতিবছর ইজারার মাধ্যমে মাটি বিক্রির ব্যবস্থা করা হউক। এতে সরকার রাজস্ব বাবদ কোটি টাকা আয় করতে পারবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), কুমিল্লার নির্বাহী প্রকোশলী মো. আবদুল লতিফ বলেন, গোমতী নদীর বিভিন্ন অংশের বালুমহাল জেলা প্রশাসন ইজারা দিয়ে থাকে। কোন শর্তে এসব ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন।

জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সাঈদ বলেন, জেলা প্রশাসন মাত্র ছয়টি স্থানে সরকারিভাবে বালুমহাল ইজারা দিয়েছে, কোনো মাটিমহাল ইজারা দেয়নি। আর বৈধ বালুমহালের ইজারাদাররা শুধু নদীর মধ্যখান থেকে বালু উত্তোলন করতে পারবেন। চরের মাটি তো দূরের কথা, নদীর পাড় সংলগ্ন স্থান থেকে বালু তোলাও অবৈধ। তিনি আরও বলেন, এখন বিভিন্ন স্থানে নদীর সঙ্গে চরের জমিগুলোও শেষ করে ফেলতে চাইছে বালু ও মাটিখেকোরা। তবে এসব বালু আর মাটিদস্যুরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, আমরা তাদের ছাড় দেব না। আমরা নদী ও চরের কৃষিজমি রক্ষায় কয়েক মাস ধরে একের পর এক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা অভিযানকালে যেখানে অবৈধভাবে মাটি-বালু উত্তোলন দেখছি, সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাটি ও বালুদস্যুদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

আনন্দবাজার/শাহী/আলাউদ্দিন

সংবাদটি শেয়ার করুন