প্রথমবারের মতো গাজীপুর জেলার লাল ও ধসূর বর্ণের উঁচু জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। এদিকে সূর্যমুখী ফুলের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন সূর্যমুখী ফুলের চাষীরা। তাই কৃষকের মুখে ফুটেছে ‘‘সূর্যমুখী’’ হাসি।
দক্ষিণা লের মতো গাজীপুর জেলার মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ মৌসুমে বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন সূর্যমুখী চাষিরা। পাশাপাশি চাষিরা ফসল ঘরে তোলার কথা ভাবছেন। বর্তমানে বাজারে দাম বেশি হওয়ায় লাভবান হওয়ার আশা করছেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার ও বীজ প্রণোদনার মাধ্যমে জেলার ৫ উপজেলায় প্রদর্শনী আকারে এ বছর মোট ৩৮ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুর সদর উপজেলায় ১২ হেক্টর,কালিয়াকৈর উপজেলায় ৯ হেক্টর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৯ হেক্টর, কাপাসিয়া উপজেলায় ৬ হেক্টর ও শ্রীপুর উপজেলায় ২ হেক্টর।
গাজীপুর সদর উপজেলার বাসন গ্রামের চাষী চিত্তরঞ্জণ সরকার জানান, আমি আমার ৬৫ শতাংশ জমিতে এবার উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে নতুন এই ফসলের চাষ করি। ইশ^রের কৃপায় আমার জমিতে আশানুরুপ ফলন হয়েছে। এদিকে প্রতিদিন বিকেল হলেই আমার বাগানে অনেক লোকের সমাগম হয়। তারা এই বাগানের সৌন্দর্য দেখতে আসে এবং ছবি তুলতে আসে। যা দেখতে আমার কাছে ভীষণ ভালো লাগে। তিনি আরো বলেন, আমি আগে এই জমিতে ধান চাষ করতাম। কিন্তু উৎপাদন খরচ হিসেব করলে সেই পরিমাণ লাভ হতোনা। কিন্তু এবার সূর্যমুখীর চাষ করার কারণে মনে হচ্ছে লাভের মুখ দেখতে পারবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা সুলতানা জানান, এ বছর আমার উপজেলার ৪৪টা বøকে সূর্যমুখীর আবাদ করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারের প্রনোদনা প্রকল্পের আওতাধীন বøকও রয়েছে। যারা এবছর চাষ করেছেন,তাদের প্রত্যেককে সকল ধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র জমির চাষ বাবদ খরচ ছাড়া।
তিনি আরো বলেন, প্রতিনিয়তই কৃষকদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। সেই সাথে প্রদর্শনী মাঠ পরিদর্শনে যাচ্ছি। তবে এবছর যে সমস্ত কৃষক সূর্যমুখীর চাষ করেছেন তারা সবাই ভীষণ খুশি। কারণ, তাদের বাগানে ফুল এসছে,গুটি ধরছে । বাম্পার ফলনে কৃষকরা যেমন খুশি,ঠিক তেমনিভাবে আমরাও খুশি। আশা করছি আগামী বছর সূর্যমুখীর চাষির সংখ্যা বাড়বে এবং সবার মাঝে এই তেলবীজ ফসল উৎপাদনে আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে।
সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোঃ ওসমান সোহেল বলেন, এ বছর আমার বøক বাসন ইউনিয়নের চিত্তরঞ্জণ সরকারের প্রায় ৬৫ শতাংশ জমিতে বারি সূর্যমুখী-৩ জাতের চাষ করা হয়েছে। সঠিক পরিচর্যার ফলে আশানুরুপ ভালো ফলন হয়েছে। এতে চাষীও ভীষণ খুশি।
কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের চাষী মোঃ আব্দুস সালাম ও বেলায়েত হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, আমরা এই বছর আমাদের দুই ভাইয়ের ৬০ শতাংশ জমিতে নতুন চাষ করেছি। আগে কখনো করিনাই। আমরা তো সব সময়ই ধান চাষ করি। কিন্তু ধান চাষ করতে যে পরিমাণ খরচ হয় সেই তুলনায় ধান আমরা উৎপাদন করতে পারিনা। তবে উৎপাদন করতে পারলেও ন্যায্য মূল্যে তা বিক্রি করতে পারিনা। কিন্তু এবার ধান চাষ না করে তৈল জাতীয় ফসল সূর্যমুখীর চাষ করেছি। আল্লাহর রহমতে আশানুরুপ ফলন হয়েছে। যেহেতু বাজারে বর্তমানে তৈলের মূল্য বেশি এবং সূর্যমুখীর তৈলের মূল্য আরো বেশি,তাই অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে বেশি লাভের প্রত্যাশা করছেন তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাপাসিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার বসাক জানান, এবছর আমার উপজেলায় ৬ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। বিশেষ করে এটাতো নতুন ফসল তাই অনেক কৃষক চাষ করতে প্রথমে অনিহা ছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে আমরা তাদেরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে চাষ করাই। চাষ করার পরবর্তী দৃশ্য দেখে সত্যিই সূর্যমুখী চাষীরা আনন্দিত,বিমোহীত এবংআগ্রহী। এসব কৃষকরা আগামী বছর তাদের আবাদের পরিমাণ বাড়াবে।
তিনি আরো বলেন, সূর্যমুখীর বীজ যেমন দামী, ঠিক তেমনি এর তৈলও দামী। কোন কৃষক যদি এর বীজ এবং তৈল বাজারজাত করতে না পারে তাহলে আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে এগুলো বাজারজাত করার ব্যবস্থা করে দিবো। যাতে করে কৃষকের উৎপাদিত বীজ এবং তৈল বাজারজাত করা নিয়ে কোন ধরণের টেনশন না করতে হয়। আমি আরো আশা করছি যে, আগামী বছর কাপাসিয়ার প্রতিটি বøকে নতুন ফসল সূর্যমুখীর চাষাবাদ শতভাগ বাড়বে।
সূর্যমুখী ফুলের চাষ করলে ফুল থেকে তৈল,খৈল ও জ¦ালানী পাওয়া যায়। প্রতি কেজি বীজ থেকে কমপক্ষে ৩৮ থেকে ৪০% তৈল আহরণ সম্ভব। অন্যদিকে ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘায় ৭ মণ থেকে ১০ মণ বীজ উৎপাদন এবং সেই বীজ থেকে প্রায় ১৪০ থেকে ২০০ লিটার তৈল উৎপাদন সম্ভব। বর্তমানে প্রতি লিটার তৈলের মূল্য ২৫০ টাকা। আর প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মাহবুব আলম জানান, জেলার ৫ উপজেলায় এবার ৩৮ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড আরএসএম-২৭৫ ও বারি সূর্যমুখী-৩ এই দুই জাতের চাষ করা হয়েছে। অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখীর চাষ লাভজনক। তবে জেলায় গত বছরও সীমিত আকারে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছিলো কিন্তু এবার প্রত্যেক উপজেলায় অনেক বেশি চাষ হয়েছে। এবার সরকারের রাজস্ব কর্মসূচীর আওতায় কৃষকদেরকে কৃষি বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে সরাসরি হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। যাতে করে তারা নতুন এই ফসল আবাদে কোন রকমের সমস্যার সমুক্ষিণ না হন। প্রনোদনা খাতের আওতায় জেলার প্রতি উপজেলায় প্রদর্শনী আকারে সূর্যমুখী চাষের জন্য কৃষকদের সার ও বীজ প্রনোদনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ বিশে^র অন্যান্য দেশ থেকে সিংহভাগ ভোজ্যতেল আমদানী করতে হয়। তাই আমাদের দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠির ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে হলে সূর্যমুখীর বানিজ্যিক চাষাবাদ করতে হবে। যেহেতু এটা তৈলবীজ ফসল, আর এই বীজে তৈলের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি যে, দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বাজারে যে ভোজ্যতেল পাওয়া যায় তার থেকে বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্মত এই সূর্যমুখীর তৈল।
তিনি আরো বলেন, আগামীতে এ জেলাতে ব্যাপকভাবে সূর্যমুখী ফুলের চাষ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রত্যাশা করছি।
আনন্দবাজার/শাহী/সবুজ