শিল্প-কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য আর প্রকৃতিক জলায়তন হ্রাসে গাজীপুরের জলাভূমিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতিবেশ বিপণ। বেসরকারি সংস্থা ও কমিউনিটি গ্রুপগুলো কিছু সচেতনতামূলক প্রচারণা চালালেও জলাভূমি সুরক্ষায় সরকারি সংস্থাগুলো অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। জীববৈচিত্র্যের জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষরা পেশা বদলে ফেলেছেন।
সরেজমিনে গাজীপুরের বিভিন্ন জলাশয় ঘুরে দেখা গেছে, শিল্পকারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্যে জলাভূমিতে উদ্ভিদ ও প্রাণির অস্তিত্ব নেই। জেলার কোনো মুক্ত জলাশয়েই দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম নেই। তুরাগ, বালুনদী, বানার নদী, শীতলক্ষ্যা, বেলাইবিলসহ বর্ষায় প্লাবিত হয় এমন জলাভূমিতে জলজউদ্ভিদ ও প্রাণি খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাটবাজার, শহর ও বস্তি এলাকার গৃহস্থ বর্জ্য ফেলারও বড় ভাগার জলাশয়। দীর্ঘ দশবছর চেষ্টা করেও কালিয়াকৈর উপজেলার চারটি বিল সংরক্ষণ করে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধি করতে অভয়াশ্রম গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কালিয়াকৈর উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো: সলিমুল্লাহ্ অভিযোগের সুরে বলেন, একদিকে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে আবার কারখানার দূষিত পানিতে মাছের অভয়াশ্রম বা বিল নার্সারি করা সম্ভব হয় না। ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত।
বেসরকারি সংস্থা পরিবেশ আন্দোলন জলাভূমির ক্রমাবনতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দাবীতে মানববন্ধন, র্যালী ও প্রতিবাদ সভা করে আসছে বছরের পর বছর। জলাভূমিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সঠিকভাবে সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও উদ্যোগ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পঞ্চাশ বছর ধরে জাতিসংঘের আয়োজনে বিশ্বের জলাভূমি সংরক্ষণে দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) গাজীপুর আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান মনে করেন প্রাকৃতিক সম্পদব্যবস্থাপনা খুবই জরুরী। দখল-দূষণে জলাভূমির শ্রেণী পরিবর্তন সহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জলজপ্রাণি। হাউজিং কোম্পানীগুলো জলাভূমি ভরাট করে আবাসনসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলছে। এতে প্রাকৃতিক জলাভূমির অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সচেতনতায় কিছু কাজ করতে পারে, সাংবিধানিকভাবেই জলাভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের।
বাংলাদেশ নদী রক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ফেডরিক মুকুল বিশ্বাস বলেন, জলাভূমির আয়তন হ্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং জলাভূমির বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসযোগ্যতা সংরক্ষণে বেসরকারি সংস্থা হিসেবে আমরা বিভিন্ন প্রচারণা কার্যক্রম করে আসছি। পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর রয়েছে। সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর রয়েছে। গাজীপুরের সকল জলাভূমির পানি আজ বিষাক্ত। এই এলাকার বিষাক্ত পানিতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ পেশা পরিবর্তণ করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
গাজীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: সাখাওয়াত হোসেন ভূইঁয়া বলেন, শিল্পবর্জ্যে জলাভূমির জীববৈচিত্র্যে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশে মৎস্যচাষ বাড়লেও বর্ষায় প্লাবিত প্রকৃতিক জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন কমেছে।
শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্যে বিপণœ হওয়া নদীর জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ রক্ষা বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুরের সহকারি পরিচালক মো: আশরাফ হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, অপরিশোধিত তরল বর্জ্য জলাভূমিতে ফেলারোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকি। শিল্পকারখানার কিছু অসাধু মালিক রাতের আঁধারে ইটিপির অপরিশোধিত তরল বর্জ্য জলাভূমিতে ফেলছে। সকল কারখানার ইটিপি প্রযুক্তির মাধ্যমে অনলাইনে ২৪ঘন্টা মনিটরিং করতে পারলে দূষণরোধ করা সম্ভব। এছাড়া জবরদখল হওয়া জলাভূমি পুনঃরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে।
আনন্দবাজার/শাহী/সবুজ