দুর্ভোগ যেনো কাটছেই না। সীমাহীন যাতনায় পার হয়েছে দীর্ঘ ১৩ টি বছর।এবার হয়তো,আলোর মুখ দেখবে নৌপথের তিন বিভাগের মানুষ।
সুত্র জানায়, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১২ জেলা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের নয়টিসহ ২১ জেলার মানুষের আন্তঃজেলা যাতায়াতের অন্যতম রুট ভোলা-লক্ষ্মীপুর (মজুচৌধুরীরহাট) ফেরিঘাট। মোংলা সমুদ্র বন্দর ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রুটও এটি।
কিন্ত এ রুটে ২০০৮ সাল থেকে গত ১৩ বছর ধরে তীব্র নাব্যতা সংকটের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে চলছেন হাজার হাজার যাত্রী। সমস্যা সমাধানে এবং রুট সচল রাখতে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মতিরহাটে নতুন একটি ফেরিঘাটের দাবি করেছেন তারা।
যাত্রীদের দাবি, মতিরহাটে নতুন ঘাট স্থাপন করলে শুধু সময়ই নয়, নদী পথে ১০ কিলোমিটার বাড়তি পথও কমে যাবে।
বুধবার (১৮ নভেম্বর) লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাট ঘাটে গিয়ে নৌযাত্রী, পরিবহন শ্রমিক, নৌযান চালক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নৌযান চালক ও নৌকর্মকর্তারা জানান, ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌরুটে প্রতিদিন ফেরির মাধ্যমে ২শতাধিক যানবাহন এবং লঞ্চ, সীট্রাকের মাধ্যমে ৫ থেকে ১০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করেন।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, মতিরহাট ও মজুচৌধুরীরহাট উভয় স্থান থেকে লক্ষ্মীপুর জেলা শহর হয়ে অন্য গন্তব্যে আসা-যাওয়া করা যায়। লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে সদর উপজেলার মজুচৌধুরীরহাটের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার এবং মজুচৌধুরীরহাট থেকে ভোলার ইলিশাঘাটের দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে কমলনগর উপজেলাধীন মতিরহাটের দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার এবং মতিরহাট থেকে ভোলার ইলিশাঘাটের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ভোলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভোলা থেকে নদী পথে লক্ষ্মীপুরের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার (বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে)। কিন্ত বর্তমানে নৌপরিবহনের জন্য অর্ধবৃত্তাকার এ রুটের মোট দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। যার মধ্যে মেঘনা নদীর ইলিশা থেকে মতিরহাটের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার ফেরি পারাপারে সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা।
অন্যদিকে, মেঘনা নদীর রহমতখালী চ্যানেল হয়ে মতিরহাট থেকে মজুচৌধুরীরহাটের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। নদীতে জোয়ার থাকলে এখানে ফেরি চলাচলে সময় লাগে ৭৫ মিনিটের বেশি। জোয়ার না থাকলে চলাচল সময় বাদেও প্রায় ৩ ঘণ্টা নদীতে থাকতে হয়।
রুটের লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাট থেকে কমলনগরের মতিরহাট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এ চ্যানেলে সারা বছরই তীব্র নাব্যতা সংকট থাকে। নিয়মিত ড্রেজিং করেও সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না।
নদীতে জোয়ার না থাকলে মতিরহাট বাজারের ১০০ ফুট পাশেই প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা নদীতে আটকে থাকে যাত্রীবাহী জাহাজ ও ফেরি। তখন ফেরি ও জাহাজের অনেক যাত্রী নেমে মতিরহাটবাজার হয়ে গন্তব্যে যান।
যাত্রীদের দাবি, মতিরহাটে নতুন একটি ঘাট স্থাপিত হলে যাত্রী ও ফেরির যানবাহনকে আর নদীতে আটকে থাকতে হবে না। এতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় বাঁচবে।
সরকারি চাকরিজীবি আরাফাত হোসেন জানান, বর্তমান মজুচৌধুরীরহাট ঘাটের সঙ্গে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের যেমন সংযোগ রয়েছে, তেমনি মতিরহাট বাজারের ঘাটের সঙ্গেও লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের রয়েছে সংযোগ।
তিনি আরও জানান, শুধু বর্ষার ২ মাস বাদে বাকি ১০ মাসই জাহাজ ও ফেরিগুলো প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা নদীতে আটকে থাকে। এতে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের কষ্টের সীমা থাকে না। অন্যদিকে, ফেরিতে থাকা কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যায়। দু’পাশে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন।
এ পথের নিয়মিত যাত্রী, চট্টগ্রাম বন্দরের চাকরিজীবী ও ভোলা জেলার বাসিন্দা সুমন ভৌমিক অভিযোগ করেন, ফেরিঘাট প্রতিষ্ঠাকালীন (২০০৮) সময়ে নৌযান পারাপারের সুবিধার চেয়েও স্থানীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে লক্ষ্মীপুরে সঠিক জায়গায় বাছাই করা হয়নি। তার মতে, সে কারণে গত ১৩ বছর ধরে হাজার হাজার যাত্রী বাধ্য হয়েই যাতায়াতে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করছেন।
মজুচৌধুরীরহাট ফেরিঘাট এলাকায় দায়িত্বরত বিআইডব্লিউটিসির পরিদর্শক পিয়ার আহাম্মদ ফরাজি জানান, ডুবোচরে নৌযানগুলো আটকে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে বসে থাকতে হয়। সারা বছর ড্রেজিং করেও এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
লঞ্চ মালিকরা জানান, মেঘনার রহমতখালী চ্যানেলের মতিরহাট থেকে মজুচৌধুরীরহাটের ১০ কিলোমিটার অংশটি যাত্রী ও নৌযান চালকদের কাছে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। অক্টোবর থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত পুরো ৭ মাস ভাটার সময় ডুবোচরে ফেরি ও লঞ্চ আটকা পড়ে।
মতিরহাট ফেরিঘাট বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব মেহেদী হাসান লিটন জানান, সারা বছর ভোলা থেকে লক্ষ্মীপুরে ফেরি চলাচল নিশ্চিত করতে ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় মতিরহাটে ফেরিঘাট স্থাপনের জন্য পরিদর্শন হয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত অদৃশ্য কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি।
ভোলা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনালের আর্ন্তজাতিক সমন্বয়ক ও রুটে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রী মোঃ জহিরুল আলম জানান, লক্ষ্মীপুর হয়ে চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মতিরহাটে ঘাট স্থাপন জরুরি। সেজন্য ভোলা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক জেলাবাসীর পক্ষে গত বছরের ১০ জুলাই তারিখে নৌ-মন্ত্রণালয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করেন।
লক্ষ্মীপুরের মতিরহাটে নৌযান ঘাট স্থাপন বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) উপ-পরিচালক (গণসংযোগ) মোবারাক হোসেন মজুমদারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, লক্ষ্মীপুর-ভোলা রুটের ভোলা-মতিরহাটে সারা বছরই নাব্যতা রয়েছে। কিন্তু মতিরহাট-মজুচৌধুরীরহাটে (লক্ষ্মীপুর) তীব্র নাব্যতা সংকটের কারণে রুট সচল রাখতে এবং ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে নৌমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে বিআইডব্লিউটিএ মতিরহাটে ফেরিঘাট স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা বাস্তবায়িত হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান জানান, ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরি রুটটি সচল রাখতে কিংবা মতিরহাটে নতুন ফেরিঘাট স্থাপনের জন্য সকল রাজনীতিবিদের এগিয়ে আসা উচিত। এতে করে এ রুটের মর্যাদা বাড়বে।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খুলনা-বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (এন ৮০৯) বাস্তবায়নের জন্য ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌরুট চালু করা হয়। তাতে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে খুলনার দূরত্ব কমে যায় ২৪০ কিলোমিটার। রুটে যানবাহন পারাপারের জন্য ফেরি এবং যাত্রী পারাপারের জন্য লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হয়।
সচেতন মহল মনে করছেন, অচিরেই ৩ বিভাগের মানুষের ১৩ বছরের দুর্ভোগের অবসান হবে।সেইসাথে লক্ষ্মীপুরের খালে এ রুটের যাত্রীদের আর ৪ ঘন্টা অতিরিক্ত আটকে থাকতে হবে না।
আনন্দবাজার/শাহী/গাজী