সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক অতীত। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন। তেমনি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের চাকমা রাজবাড়ী।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কপথে ৩৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক পথে ৪৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ইছামতী নদীর তীরে ঘেঁষে এক বুক প্রাচীন ইতিহাসের কান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্ন নির্দশনযুক্ত পরাক্রমশালী চাকমা রাজপ্রসাদের ভগ্নাবশেষ। অযত্নে অবহেলায় নিশ্চিহ্নপ্রায় রাজপ্রসাদটি। এই ইউনিয়নের রাজাভূবণ গ্রামের মাটিতে পা রাখলেই ভেসে আসে ৩ শত বছরের পুরনো ঐতিহাসিক প্রত্ন নিদর্শনের ইতিহাসের গন্ধ। অথচ নিশুতি রাতের জ্যোৎস্না ভেজা চাঁদ আজও অতন্দ্র প্রহরায় রয়েছে৷ আগলে রেখেছে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য৷ বহন করে চলেছে রাজকুঠিরের প্রতিটি ক্ষয়ে যাওয়া ইট পাথরকে। রাজবাড়ির শতাব্দী প্রাচীন রাজদীঘির দু’পাড় দক্ষিণা বাতাসের তালে ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে আজও আছড়ে পরে জলস্রোত।
রাজ পরিবারের নথি ঘেঁটে জানা যায়, সতেরো শতকের দিকে ভারতবর্ষ যখন মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনাধীন। তখন মোগল বংশধর সেরমুর্ত খাঁ ১৭৩৭ সালে সর্বপ্রথম এখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মুলত ১৭৩৭ সাল থেকেই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় চাকমা রাজত্বের গোড়াপত্তন শুরু হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার মাতামুহুরি নদীর অববাহিকায় আলীকদমে ছিল তার রাজধানী। তাঁর রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে ফেনী, দক্ষিণে শঙ্খ নদী, পূর্বে লুসাই পাহাড় এবং পশ্চিমে নিজামপুর রাস্তা। সেই সময় আরাকানিদের অত্যাচারে তিনি মোগল নবাবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। তখন চট্টগ্রামের নবাব ছিলেন জুলকদর খাঁ। তিনি সেরমুস্ত খাঁকে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। ১৭৫৭ সালে সেরমুস্ত খাঁ মৃত্যুর পর রাজা হন শুকদেব রায়। তিনি ছিলেন সেরমুস্ত খাঁর পোষ্যপুত্র। রাজা শুকদেব রায় আলীকদম ছেড়ে চাকমা অধ্যুষিত রাঙ্গুনিয়ার পদুয়ায় শিলক নদীর তীরে প্রাসাদ তৈরি করেন। নাম দেন সুখবিলাস। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন রাজধানী। তাঁর রানীর নাম ছিল ছেলেমা। রাজা শুকদেব রায়ের সন্তান ছিল না। তিনি তাঁর রানীর নামানুসারে রাজপ্রাসাদের পশ্চিম দিকে একটি পুকুরের নামকরণ করেন ছেলেমা পুকুর।
পরে রাজ্য পরিচানা ও বসাবাসের জন্য শুকদেব রায় দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের রাজাভূবণ গ্রামে নির্মিত করেন দ্বিতল রাজপ্রাসাদটি। এটি সময়ের সেরা কারুকাজ ও শৈল্পিকতায় নির্মাণ করা হয়। এই রাজকুঠিরের নির্মাণশৈলীর প্রতিটি পরতে পরতে রাখতেন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। প্রসাদটির নিচ তলায় ৬টি ও দ্বিতীয় তলায় ৪টি কক্ষ। ভবনটি তৈরি হয় ইট, সুরকি ও লোহাবিহীন। এতে ব্যবহৃত হয় চারকোণাকৃতি ইট। ইটগুলো তৈরি দেয়াঙ পাহাড়ের মাটি দিয়ে। সঙ্গে চুন-সুরকির মিশেলে নির্মিত হয় রাজপ্রসাদটি। প্রসাদের প্রবেশপথে ছিল রাজদরবার, সৈন্যশালা ও বন্দিশালা। পাশেই প্রবেশমুখে ছিল বড় একটি সান বাধাঁনো পুকুর। তার পশ্চিম পাশেই আছে শাক্ষ্যমনি বৌদ্ধ-বিহার। তৎসংলগ্ন কালীন্দিরানী ও তাঁর স্বামী রাজা ধরণ বক্স খাঁ’র ২টি চিতা মন্দির রয়েছে। এবং বাংলাদেশের প্রথম থেরবাদী বৌদ্ধদের প্রথম ভিক্ষু সীমাগার এখানেই অবস্থিত।
পরবর্তীতে দক্ষিণ রাজনগরে প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী (পূর্বপার্শ্বে) এলাকায় কালীন্দিনী রানী খনন করেন সাগর দীঘি, স্থাপিত করেন রাজারহাট। কালীন্দিনীরানীর নামানুসারে রানীরহাট এবং রাজা ভূবণ মোহন রায়ের নামানুসারে রাজাভূবণ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৭৭৬ সালে রাজা শুকদেব রায়ের মৃত্যুর পর তাঁদের বংশধর শের দৌলত খাঁ রাজ্যভার নিয়ে যখন রাঙামাটির রাজবাড়িতে রাজত্ব স্থানান্তর করেন। সেই থেকে দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের রাজাভূবণ গ্রামে অবস্থিত রাজপ্রাসাদ, সৈন্যশালা ও বন্দিশালা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
৫২ একর জায়গাজুড়ে ৩শ’ বছরের প্রাচীন এই ঐতিহাসিক রাজপ্রসাদটি বর্তমানে অযত্ন-অবহেলায় ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। তারপরও রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের বহু উত্থান-পতনের ঘটনা ও কালের সাক্ষী হয়ে।
রাজপ্রাসাদটি এখন লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত। ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই লোহাবিহীন রাজপ্রাসাদটির দেয়ালগুলো প্রস্থ ছিল দুই হাতেরও বেশি। দেয়ালগুলো এখন নানা রকম আগাছা, তরুলতা ও ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে। কালক্রমে খসে পড়েছে প্রসাদের ছাদ। রোদের খরতাপে শুকিয়ে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে প্রাসাদটি একেবারে নড়বড়ে অবস্থা। নড়েবড়ে অবকাঠামোর কারণে তেমন একটা পরিস্কার করাও সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও যতটুকু সম্ভব ঝোপঝাড় পরিস্কার করে ধ্বংসাবশেষ রাজপ্রাসাদটি টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এদিকে কালে কালে রাজার বংশধরেরা রাজপ্রাসাদ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালালেও সংরক্ষণের অভাবে শেষ রক্ষা হয়নি। রাজপ্রাসাদ রক্ষায় দীর্ঘ ২০ বছর রাজ বংশধর হিসেবে প্রয়াত প্রমতোষ দেওয়ান দেখাশোনা করেছেন। ২০১৩ সালে তিনি পরলোকগমন করলে তাঁর ছেলে রুমেল দেওয়ান রাজপ্রাসাদটি আঁকড়ে এখনো পড়ে আছেন। এর মধ্যেও প্রায় হারিয়ে গেছে প্রাসাদটির রাজদরবার, হাতিঘোড়ার পিলখানা, বিখ্যাত সাগরদীঘি, পুরাকীর্তি, বৌদ্ধ-বিহারসহ গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। তবে রাজবাড়ির সান বাঁধানো পুকুর, সাগরদীঘির আংশিক অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। অথচ কোন সরকারই এই রাজপ্রাসাদটি প্রত্ননির্দশন হিসেবে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়নি কোন সময়ে।
২০০৭ সালে বর্তমান রাজ দেবাশীষ রায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়া পর রাঙ্গুনিয়ার মানুষ আশা করেছিল রাজপ্রাসাদকে সংস্কারের মধ্যমে গড়ে উঠবে একটি পর্যটন কেন্দ্র। সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে ৩শ’ বছরের পুরনো রাজকুঠিরের। ২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে রাজা দেবাশীষ রায় সরকারিভাবে রাজবাড়ি এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন। সংরক্ষণের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু এখনো কোনো সংস্কার করা হয়নি।
সম্প্রতি রাঙ্গুনিয়ার সপ্তদশ শতাব্দীর বিলুপ্ত চাকমা রাষ্ট্রের রাজপ্রাসাদটি সংস্কারের করে (আধিবাসী ভিলেজ ও রয়েল মিউজিয়াম) জাদুঘরে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিয়ে সমীক্ষা করছে প্রত্নসম্পদ বিশেষজ্ঞের একটি টিম। খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-এর অর্থায়নে রাঙ্গুনিয়া চাকমা রাজার রাজপ্রাসাদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমীক্ষা, মাপজোখ, অনুসন্ধান ও উৎখনন শুরু করেন।
গত ২৯ অক্টোবর রাজানগরের রাজপ্রাসাদের প্রাথমিক সমীক্ষা করছেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্বতত্ত্ববিভাগের প্রফেসর মোকাম্মেল হোসেন ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, স্থপতি আশিষ চাকমা ও প্রত্নসম্পদ বিশেষজ্ঞ টিমসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি টিম। তাদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় সমাজকর্মী আব্দুল মান্নান তালুকদার, হেলাল তালুকদার, রাজবংশের সদস্য রুমেল দেওয়ান। এসময় উপস্থিত ছিলেন রাজ রাজত্বের ইতিহাসের গবেষক এনায়েতুর রহিম।
এব্যাপারে রাজ রাজত্বের ইতিহাসের গবেষক এনায়েতুর রহিম বলেন, ‘বিলুপ্ত রাঙ্গুনিয়া চাকমা রাষ্ট্রের রাজধানী রাজানগরের রাজপ্রাসাদের সমীক্ষা শেষ হলে গড়ে উঠবে (রয়েল মিউজিয়াম) চাকমা জাদুঘর, আদিবাসি ভিলেজ ও পর্যটন। সংস্কার ও সংরক্ষণ হবে ইতিহাসের সপ্তদশ শতাব্দীর চাকমা রাজত্বের হারানো গৌরব।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৭ সালে প্রথম কখনো গাড়ি করে, কখনো পদব্রজে চাকমা রাজত্বের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করি। এখনো গবেষণার শেষ সুড়ঙ্গের আলোতে পৌঁছতে পারেনি। দিনরাত কখনো সুযোগ পেলে গবেষণার কাজ করি। কেননা ইতিহাসের দায়বদ্ধতা আছে। ভবিষ্যত নতুন প্রজম্মের কাছে ইতিহাসের গুরুত্ব ও মূল্যবোধ তুলে ধরতে বিলুপ্ত চাকমা রাষ্টের শিকড়ের অনুসন্ধান করে রাঙ্গুনিয়ার গৌরবান্বিত পথ চলতে একটি ইতিহাস রচনা করতে চাই। দীর্ঘদিন পর আমার গবেষণা সফলতার দ্বারপ্রান্তে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে।’
এবিষয়ে সমীক্ষা টীমের সদস্য চবির ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, ‘এটা হলো ঐতিহাসিক সভ্যতার নগরী। এখানে ঐতিহাসিক যে স্থাপনা গুলো রয়েছে, সেগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সংস্কার, মেরামত ও সংরক্ষণের প্রয়োজন। আমরা ইতিহাসবিদ, স্থাপিত ও প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ মিলে বিষয়টি গবেষণা করে এটার ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, স্থাপত্যশৈলীর গুরুত্ব, নৃ-তাত্বিক ও স্থানীয় ইতিহাসের গুরুত্বের সবগুলো দিক বিবেচনা করে আমরা মনে করছি, এই রাজপ্রাসাদের সংরক্ষণের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেজন্য আমরা একটা সমীক্ষা প্রকল্প হাতে নিয়েছি।’
তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের অর্থায়নে আমরা এই সমীক্ষা প্রকল্প পরিচালনা করছি। প্রকল্প সমাপনান্তে একটি প্রতিবেদন জমা দেবো। ওই প্রতিবেদনের আলোকে তারা একটা বিস্তারিত সংস্কার পরিকল্পনার প্রজেক্ট প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন। সেই সাথে প্রত্নসম্পদের মালিক বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায়ের সম্মতি ও পরামর্শনুযায়ী তাঁর ব্যাবস্থাপনায় এবং সরকারের সহযোগিতায় সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পরমর্শ দেবো। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রাজাদের এখানকার ইতিহাসের যে ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পারে। শুধু তাই নয়, এখানে জাদুঘর স্থাপনের মধ্য দিয়ে যাতে একটি ঋতু রাজ্যের যাবতীয় কর্মকাণ্ড গুলো নিদর্শনের আলোকে ফুটিয়ে উঠে। সে ব্যবস্থা যাতে দ্রুত গ্রহণ করা যায় সেব্যাপারে আমরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করবো।’
স্থানীয়দের দাবি, রাঙ্গুনিয়া তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে কালক্রমে বিলুপ্তপ্রায় ৩শ’ বছরের পুরনো ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে দক্ষিণ রাজানগরের চাকমা রাজপ্রসাদটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি। ৩ শ’ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে রাজপ্রাসাদটি সংস্কার করলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে।
আনন্দবাজার/শাহী/মতিন