রাজধানী ঢাকার অতি সন্নিকটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা। যার আয়তন ২৩৪.৭৬ বর্গ কিলোমিটার। ৭ টি ইউনিয়ন, ২ টি পৌর সভাসহ ১৪৫ টি মৌজা ও ২২২ টি গ্রাম রয়েছে। এতে মোট জমি রয়েছে ৪৩ হাজার ৯৭৪ দশমিক ৪১ একর। আর কৃষি জমির পরিমান হল ৩৫ হাজার ৪৮০ দশমিক ৬৯ একর। মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৩ হাজার ৬২৯ জন। মোট ভোটার রয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭০৭ জন। এক ফসলী জমি ৬হাজার ৬৩০ হেক্টও, দুই ফসলী জমির পরিমান ৪৮৫০ হেক্টর, তিন ফসলী জমি রয়েছে ২ হাজার ১৩০ হেক্টর। মোট আবাদি জমির পরিমান ১৩ হাজার ৮১০ হেক্টর। প্রান্তিক কৃষক আছেন ১৬ হাজার ৫৭৬জন। ক্ষুদ্র কৃষক আছেন ১০ হাজার ২৫২ জন। মাঝারি কৃষক ৩ হাজার ৪১৭ জন। বড় আকারের কৃষক রয়েছেন ৩৬০ জন। কৃষকরা ফসলি জমিতে মোট খাদ্য উৎপাদন করেন ৫১ হাজার ৭২০ মেঃটন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুষ্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে কৃষি জমি ও জলাশয় ভরাট করা যাবে না। কোনো প্রকার আবাসন তৈরি করা যাবে না। তারপরও রূপগঞ্জে কিছু আবাসন কোম্পানী কৃষকর দু’ তিন ফসলী জমি না কিনেই অবৈধভাবে বালু ফেলে ভরাট করে ফেলছে। এব্যাপারে রূপগঞ্জের কৃষক ও জেলেরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কৃষক বলেন, “জমিই আমার ভরসা। বাপ দাদারা হাল চাষ করে খেত। আমরাও জমিতে ধান, সরিষা, তিল, গম, ভুট্টা, আখ, পাটসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করতাম। বর্ষায় সেই জমিতে মাছ ধরে খেতাম। আমার জমিটুকু না কিনেই ভরাট করে ফেলেছে। এখন আমি খাব কি? বউ পোলাপান নিয়ে পথে দাড়ানো ছাড়া আর উপায় রইল না। আল্লাহর এই দুনিয়ায় বিচার নাই। গরীবের পক্ষে কেউ নাই। জমি ভরাট করে ফেলেছে কথাও বলতে পারি না। আমরা যাব কোথায়? নেতারা এগুলো চোখে দেখে না”।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে কৃষি জমি ও জলাশয়। রাজধানী ঢাকার অতি সন্নিকটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ছোট্ট একটি উপজেলা। রূপগঞ্জে গত ১০ বছরে অস্বাভাবিক পরিমাণে কমছে কৃষি জমি ও জলাশয়। অপরিকল্পিত ও অবৈধ আবাসণ প্রকল্পের জন্য এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন আবাসণ কোম্পানির প্রভাবের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে জমি হারানোর ভয়ে রয়েছে। আতঙ্কে রয়েছেন কায়েতপাড়া, দাউদপুর ও রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের বাসিন্দারা। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন ওই এলাকার কৃষক ও জেলেরা এখন অসহায়। জমি-জলাশয় দ্রুত কমে যাওয়ায় কাজ হারিয়ে ফেলছেন তারা। একরকম বাধ্য হয়েই পেশা পাল্টাচ্ছেন তারা। শীতলক্ষ্যা নদী অববাহিকায় ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উভয় পাশের এ উপজেলায় গড়ে ওঠেছে রাজধানী উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্প। তুলনামূলকভাবে জমির দাম কম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় এখানে একের পর এক বেসরকারি আবাসণ প্রকল্প গড়ে ওঠেছে। এতে স্থানীয়ভাবে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি লাভবান হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কৃষক পরিবারগুলো জমি হারানোর ভয়ে রয়েছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে রূপগঞ্জে কৃষিজমি কমেছে ২ হাজার ১৬০ হেক্টর । ২০০৯ সালেও এলাকায় কৃষিজমির পরিমান ছিল ১৩ হাজার ৮১০ হেক্টর। ২০১১ সালে ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর। এখন আছে ১১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, কৃষিজমি ও জলাশয় কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বর্গাচাষি ও জেলেরা। তারা বেকার হয়ে পড়ছেন। অন্যের সহায়তা এবং দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন অনেকে। রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কায়ছুন রাহাত হাওলাদার বলেন, ১০ বছর আগে কৃষক পরিবার ছিল ৪৪ হাজার ৬৪২টি। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে রাজউকের পূর্বাচল আবাসণ প্রকল্পের জন্য রূপগঞ্জে দেড় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে। এরপর থেকে এখানে জমি বেচাকেনা বেড়ে যায়। এভাবে প্রতি বছরই কৃষিজমি ও জলাশয় কমে যাচ্ছে।
কৃষিজমির মতো রূপগঞ্জের মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণও অস্বাভাবিক পরিমানে কমছে। ভরাট হচ্ছে খাল-বিল, গড়ে ওঠছে আবাসণ প্রকল্প। ২০০৮ সালে পুকুর ও দিঘি ছিল ১ হাজার ৪২৪ টি। এখন রয়েছে মাত্র ৯০০ টি। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, মুক্ত জলাশয় কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া মাছের উৎপাদন কমে গেছে। গত ১০ বছরে বেকার হয়েছেন ৫৫৪ জন জেলে।
উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের কৃষক আমির হোসেন আগে যে জমিতে ধান চাষ করতেন, তা এখন ভরাট করে ফেলা হয়েছে। আমিরের হারানো চাষভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে দেওয়াল তোলা হয়েছে। ভেতরে বহুতল ভবন হবে। ফসলি এ জমি বিক্রি করে মালিক বিদেশে চলে গেছেন। আমির হোসেন বলেন, এলাকায় তার মতো অনেকেই এখন কৃষিকাজের সন্ধ্যানে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ান। আমির হোসেনের মতো একই অবস্থা মুড়াপাড়া এলাকার জেলে পূণ্য চন্দ্র দাসের। আগে মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন আগের মতো মাছ পাচ্ছেন না। এখন বছরের বেশির ভাগ সময়ই বেকার থাকেন তিনি।
রূপগঞ্জ উপজেলায় ৭ টি ইউনিয়ন ও ২ টি পৌরসভা রয়েছে। এদের মধ্যে কায়েতপাড়া, রূপগঞ্জ সদর, কাঞ্চন, দাউদপুর, গোলাকান্দাইলে আবাসণ প্রকল্পের জন্যে কৃষিজমি ও জলাশয় বেশি ভরাট হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুশরাত জাহান বলেন, রূপগঞ্জে এখন ৪০ টির মতো আবাসণ প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানিরই অনুমোদন নেই। আবাসণ প্রকল্প ছাড়াও কৃষিজমি ভরাট করে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও বাড়ি তৈরি করার প্রবণতা বেড়েছে।
স্থানীয় মুড়াপাড়া চায়ের দোকানি রহিম মিয়া বলেন, এক বছর আগে যে জমিতে ধান সহ বিভিন্ন সবজির চাষ হত – সেখানে এখন বাড়ি হচ্ছে। রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান ভুঁইয়া বলেন, কৃষিজমি ও জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে আবাসণ কোম্পানীগুলোর কারণে। তারা মাসলম্যান পুষে। একটি জমির পাঁচজন অংশীদারের একজনকে কিছু টাকা দিয়ে পুরো জমি দখল করে নিচ্ছে অনেক কোম্পানি। তাদের শক্তি ও টাকার কাছে জনপ্রতিনিধিরাও অসহায়।
আনন্দবাজার/শাহী/ফয়সাল