নওগাঁর মহাদেবপুরে অবৈধভাবে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কাজ চলছিল একটি কারখানায়। আর এই কারখানা থেকে নির্গত হয় বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। তাতে করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা ও গবাদি পশুগুলো। এমনকি নষ্ট হচ্ছে জমির ফসলও। ওই এলাকার মাঠের ঘাস খেয়ে গবাদি পশু মারা যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা মিলে নওগাঁর মহাবেপুর উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের শাহাজাতপুরে অবস্থিত মেসার্স হাজেরা রাইচ মিলের চারপাশে টিনের তৈরি ঘেরা সীসা কারখানার। কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও কাছে গেলেই বোঝা যায়, ভেতরে রয়েছে একটি সীসা কারখানা। এখানে পুরনো ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কাজ চলে রাতের অন্ধকারে। কারখানায় ধোঁয়ার কারনে আশপাশের এলাকায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিশেষ করে আশেপাশের জমির আইলের ঘাস খেয়ে এ পর্যন্ত মোবারকসহ স্থানীয় ৪জন কৃষকের ৬টি গরু ও ২টি ছাগল মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় শাহজাদপুর গ্রামের কৃষক মোবারক হোসেন (৬৬) এর ২০দিন পূর্বে ১৫হাজার টাকা একটি গরু কিনেছেন মোটাতাজা করনের জন্য। মোবারক হোসেন বলেন, গত ১২ই নভেম্বর ( বৃহস্পতিবার ) সকালে একটি গরু ও একটি ছাগল ওই কারখানার পাশে জমিতে ঘাস খাওয়ানোর প্রায় দুই ঘন্টা পর হঠ্যাৎ গরুর মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকে তার পর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর গরুটি মারা যায়। তার কিছুক্ষন পর ছাগলটিও বমি করতে করতে মারা যায়। এত দ্রুত মারা যায় যে গরুটির চিকিৎসা করানোর সময়ই পাইনি।
তিনি আরও বলেন, আমি গরীব মানুষ আমার দুই ছেলে ভ্যান চালিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। আমাদের খুব অভাবের সংসার। অনেক কষ্ট করে জমানো টাকা দিয়ে গরুটি কিনেছিলাম। আর ছাগল গত এক মাস পূর্বে ৩হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। কিছুদিন মোটাতাজা করে বাজারে গরু ও ছাগলকে বিক্রি করবো যাতে করে কটা টাকা আয় হয়। কিন্তু আমার আয়ের সম্বল শেষ হয়ে গেল। আমার সুস্থ সবল গরু ও ছাগল মাঠে ঘাস খাওয়ানোর পরেই মারা গেছে। অন্য কোন রোগ বালাই ছিলনা। এর একটিই কারন ব্যাটারির গলানোর কারনে বিষাক্ত ধোঁয়া জমির ঘাসের সাথে মিশে যায় সেটা খাওয়ার কারনেই গরু ও ছাগল মারা গেছে। আমি এর ন্যায্য বিচার চাই।
মোবারক হোসেনের জামাই শামসুদ্দিন বলেন, গত পাঁচ দিন পূর্বে (১৬ই নভেম্বর সোমবার) সকালে সীসা কারখানার পাশের জমিতে আমার তিনটি গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাই এর পর দুপুরে গরুকে বাড়িতে নিয়ে আসার কিছুক্ষন পর গরু তিনটির মুখ দিয়ে বমি হতে থাকে। তার পর মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে তার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমার গরু তিনটি মারা যায়। আমার গরু তিনটির বাজার মূল্য প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।
শাহজাদপুর গ্রামের দিলিপ চন্দ্র রায়, জানান গত ১৫দিন পূর্বে আমার একটি গরু মারা যায় ওই সীসা কারখানার পাশের জমি খাওয়ানোর পর। মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গরুটি মারা যায়। আমার সুস্থ গরু কোন রোগ ছিলনা।
স্থানীয় মুক্তি চন্দ্রা বলেন, গত সোমবার আমার একটি গরু ও একটি ছাগল মারা যায় কারখানার ওখানে জমির ঘাস খেয়ে। কোন রোগ ছিলনা। ঘাস খাওয়ার পর মুখে ফেনা ওঠে মারা যায়। একটি গরু ও একটি ছাগলের মিলে প্রায় ৬০হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমার সংসারে এক মেয়ে তারও বিয়ে হয়ে গেছে কিছুদিন পূবে প্রতি (স্বামী ) স্বর্গীয় হয়েছেন কয়েক বছর আগে। এখন সংসারে আয়ের উৎস তেমন নাই । এর মাঝে গরু ও ছাগল অকালে মারা গেল। অভাবের সংসারে আরও অভাব জেকে বসলো।
সীসা কারখানার মালিক (বগুড়া সদররের বাসিন্দা ) আরিফ হোসেন এর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা তো মাত্র চলতি মাসের (নভেম্বর) শুরুর ৭দিন ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদন এর কাজ করছিলাম। জাহেরা রাইচ মিলের মালিক এর নিকট থেকে ভাড়া নিয়ে কাজ করছিলাম। পরে স্থানীয়দের নানা অভিযোগের কারনে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে আমার ব্যাটারি গলানোর কারনে তার ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে যাওয়ার কারনে সেটা গবাদি পশু খেয়ে মারা গেছে তা আমার জানা নেই। সীসা কারখানা চালানোর জন্য প্রশাসনিক অনুমতি ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই তো নিয়মনীতির বাহিরে করছে এমন কাজ তাদের কি অনুমতি নেয়া আছে কি এটা বলার পর তিনি ফোন কেটে দেন।
জাহেরা রাইচ মিলের মালিক হেমায়েত হোসেন ঝন্টু বলেন, স্থানীয়দের গবাদি পশু মারা যাচ্ছে সেই সাথে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এমন অভিযোগ স্থানীদের কাছ থেকে পাওয়ার পর আমি গত বৃহস্পতিবার আমার রাইচ মিলে ব্যাটারি গলানো বন্ধ করে দেই। যেহেতু রাইচ মিল বন্ধ ছিল আর যারা ব্যাটরি গলানোর জন্য (আরিফ হোসেন) বলেছিল কাগজপত্র বা অনুমতি নেয়া আছে প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া তাই আমি বিশ্বাস করে তার কাগজপত্র না দেখেই ভাড়া দিয়েছিলাম। বর্তমানে কারখানা বন্ধ আছে ।
স্থানীয় খাজুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলেন, অবৈধভাবে ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদন হচ্ছে জানার পর ৮নং ওয়ার্ডের মেম্বার আরিফুল ইসলামকে সেই সীসা কারখানায় কয়কদিন আগে পাঠালে কারখানার সবাই পালিয়ে যায়। আর যাদের গরু ছাগল মারা গেছে তারা কেউই আমার সাথে যোগাযোগ করে নাই। তারপরও আমি খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখবো।
জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মো.মহির উদ্দিন বলেন, পর্যাপ্ত নিয়মকানুন না মেনে খোলা পরিবেশে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কারনে সেটার বজ্র ও ধোঁয়া পরিবেশে যায়। যা পরিবেশ, মানুষ ও গবাদিপশু পাখির জন্য মারাত্বক ক্ষতি সাধান করে। গত কিছুদিন পূর্বে নওগাঁর ধামুইরহাটে অবৈধভাবে ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদনের কারনে সেখানকার ধোঁয়া জমির ঘাসে মিশে বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় সেই ঘাস গরু খাওয়ায় গরুটি মারা যায়। নওগাঁতে গরুর রোগ নিয়ন্ত্রন এর জন্য পরিক্ষাগার নাই পাশ্ববর্তী জেলা জয়পুরহাটে আছে। তবে যেখানে অবৈধভাবে নিয়ম না মেনে ব্যাটারি গলিয়ে সীসা উৎপাদন করা হবে সেখানকার আশে পাশের জমির ঘাস যদি গবাদিপশু যদি খায় তবে অবশ্যই গবাদিপশুর মারাত্বক ক্ষতি হবে। এমন কি প্রাণহানিও হতে পারে কারন সেটা বিষাক্ত হয়ে যায়।
এবিষয়ে মহাদেবপুর উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) মিজানুর রহমান ফোনে জানান, অবৈধ সীসা কারখানার বিষয়ে জানা নেই তবে যদি সীসা কারখানায় গলানো ধোয়া জমির ঘাসে সাথে মিশে যাওয়ায় সেই ঘাস গবাদিপশু খেয়ে মারা গেছে বা পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে এমন অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তাছাড়া আপনার কথা অনুযায়ী যদি কারো গবাদি পশু মারা যায় সীসা কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া বা বজ্রের কারনে তাহলে ভোক্তভোগিরা অভিযোগ করলে আমি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
আনন্দাবাজার/শাহী/অনিক