- জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন দেশ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
- জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো।
- এর প্রভাবে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ স্বপ্নের সেন্টমার্টিন অচিরেই বিলীন হবার শংঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত একদশক ধরে সেন্টমার্টিনের চতুর দিকে ভাঙন অব্যাহত থাকলেও ভাঙন প্রতিরোধের কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা। চলতি বর্ষায় প্রতিদিন নতুন নতুন ভাঙন যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অংশে অবিশ্বাস্য ভাঙনে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেন্টমার্টিন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ের সময়ও সেন্টমার্টিন এতো অনিরাপদ ছিল না। এখন সাগরতীরে বসবাসরত দ্বীপবাসীর রাত কাটে আতংকে আর নির্ঘুমে। স্থানীয়রা সংশ্লিষ্টদের কাছে সেন্টমার্টিন রক্ষায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
২০১৯ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সমীক্ষা
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ এর দাবি, সাম্প্রতিক যেভাবে দ্বীপ ভাঙছে তাতে করে আগামী ১০দিন ভাঙন অব্যাহত থাকলে যে কোন সময় সেন্টমার্টিন বিলীন হয়ে যাবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সেন্টমার্টিন রক্ষায় আপদকালীন বেড়িবাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজার তাতে বাধা দিচ্ছেন। ভাঙন রোধে বিকল্প কোন ব্যবস্থাও নিচ্ছে না।
এছাড়াও নুর মোহাম্মদ বলেন, পরিবেশ অধিদফতর সেন্টমার্টিন রক্ষায় বাধা দিলেও ধ্বংসে তাদের কোন আপত্তি নাই, বরং সহায়তা রয়েছে। দ্বীপ রক্ষার্থে সেখানে দালান নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকলেও পরিবেশ অধিদফতর নিজেও তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। একইভাবে নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিও বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। প্রবাবশালীরা দ্বীপে দুইশতাধিক হোটেল মোটেল নির্মাণ করলেও কোন বাধা দেয়া হয়নি। অথচ স্থানীয়রা টিন দিয়ে বাড়ী পর্যন্ত বানাতে পারেন না বাধা দেয়া হয়। এ কারণে বেশিরভাগ ঘরবাড়ি বেড়া দিয়ে নির্মিত ও পলিথিনে মোড়ানো।
একই অভিযোগ সেন্টমার্টিন ইউপি মেম্বার ও ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হাবিব খানের। তার প্রশ্ন দ্বীপ রক্ষায় বেড়িবাধ নির্মাণে পরিবেশ অধিদফতরের আপত্তির কারণ কী?
ছবি: ইন্টারনেট
তবে পরিবেশবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে ভাঙন ছাড়াও অপরিকল্পিত পর্যটক ব্যবস্থার কারণে প্রতিদিন একটু একটু করে দেবে যাচ্ছে দ্বীপটি। চতুর্মুখী ভাঙনে ৮০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে দ্বীপ রক্ষায় বুকপেতে দেওয়া কেয়াবন। এতে করে তলিয়ে যাওয়ার শংঙ্কা বাড়ছে দ্বীপটির।
পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক আহমেদ গিয়াস বলেন, সেন্টমার্টিন ভাঙনের অন্যতম কারণ হচ্ছে- দ্বীপ রক্ষাকারী কেয়াবন, সাগর লতা নিধন,পাথর ও শৈবাল উত্তোলন। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কটেজ রিসোর্টসহ নানান স্থাপনা নির্মাণকে দ্বীপ ভাঙ্গনের অন্যতম কারণ বলা যায়।
আহমেদ গিয়াস এর মতে, দ্বীপ রক্ষায় শুধু বেড়িবাধ যথার্থ পদেক্ষেপ নয়। ভাঙন প্রতিরোধে বায়ু প্রটেক্ট- কেয়াবন, সাগরলতাকে পরিকল্পিতভাবে দ্বীপের চতুর্দিক পরিচর্যা করে দেয়াল হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
জাতীয় তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, শুধু দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের সুরক্ষায় নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কথা বলে উল্টো পথে হাটছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।
ছবি: ইন্টারনেট
তিনি বলেন, দ্বীপ রক্ষায় নিয়ন্ত্রিত পর্যটকের কথা বলা হয়েছিল, দ্বীপে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু গতবছর দেখেছি উল্টো নতুনভাবে পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য জাহাজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এভাবে শুধুমাত্র কমিশন বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে সেন্টমার্টিন ধ্বংসের প্রতিযোগীতা চলছে।
তিনদিন চেষ্টার পর পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজারের ল্যান্ডফোনে কনফারেন্স করে পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজারের উপপরিচালক শেখ নাজমুলের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন এক কর্মকর্তা।
অভিযোগের বিষয়ে শেখ নাজমুল জানান, দ্বীপ রক্ষায় বেড়িবাধ নির্মাণের চেষ্টার বিষয়টি তিনি অবগত নন। তিনি বলেন, কেউ চাইলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে পারবে না, সংশ্লিষ্ট অধিদফতর থেকে অনুমতি নিতে হবে।
ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে শেখ নাজমুল বলেন, ভবনগুলো বিভিন্ন বাহিনীর। এগুলো জাতীয় স্বার্থে নির্মাণ করা হয়েছে। আর যেসব ভবন প্রবাবশালীরা নির্মাণ করছে লোকবল সংকটের কারণে তৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে না পারলেও পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে আমরা অনুরোধ করেছি, যেন কোন ধরনের ইট, সিমেন্ট বা ভবন নির্মাণের সামগ্রী নিয়ে যেতে অনুমতি দেয়া না হয়।
ছবি: ইন্টারনেট
ঝুঁকিপূর্ণ সেন্টমার্টিন রক্ষায় পরিবেশ অধিদফতর কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জানতে চাইলে অধিদফতরের পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করার জন্য পরামর্শ দেন তিনি। তবে মুঠোফোনে একাধিবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক সোলাইমান হায়দারকে। এমনকি ক্ষুদেবার্তা দিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ সেন্টমার্টিন রক্ষায় কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা জানতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার রিং দেয়ার পরও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
ছবি: ইন্টারনেট
উল্লেখ্য, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দেশিবিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান। দ্বীপটিতে বছরে তিন থেকে চারমাস পর্যটকরা ভ্রমণের সুযোগ পায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানান বাঁধা সম্মুখিন হবার পরও সেন্টমার্টিন প্রতিবছর সাড়ে ৩ লক্ষাধিক পর্যটক ভ্রমণ করতে পারে।
বিভিন্নসূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, ১৯৬১ সালে ৭৫০ জন জনসংখ্যা ছিল সেন্টমার্টিনে। বর্তমানে জনসংখ্যা ১১হাজারের বেশি। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ৭ থেকে ১০ হাজার পর্যটক দ্বীপে ভ্রমণে যায়। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি পর্যটক রাত্রিযাপন করছে সেন্টমার্টিনে। পর্যটকদের জন্য প্রায় ২০০ শতাধিক কটেজ ও রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক