ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বীকৃতি মেলেনি আজও, কাঁদলেন জলযোদ্ধা মো. ছিদ্দিক

মুক্তিযোদ্ধা মো. ছিদ্দিক। বয়স ৮৩ বছর, বয়সে বয়স্ক হলেও আজও তিনি বীরের বেশে চলেন। যেন আরেকটি যুদ্ধে তিনি লাল-সবুজের মা’টার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কি করেছেন, কোথায় কোথায় পাক হানাদার বাহিনীকে রুখেছেন, সব স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। মুক্তিযোদ্ধা ছিদ্দিকের বড় ভাইয়ের নাম ইউনুস। ইউনুসের সঙ্গেই যুদ্ধ যাত্রা করতেন ছিদ্দিক। যুদ্ধকালে তাঁর বয়স ছিল ৩৪বছর। তারণ্যের শক্তি ছিদ্দিককে দেশের জন্য কিছু করার সাহস জুগিয়েছে, শক্তি জুগিয়েছে অন্যায়কে ‘না’বলার। যুদ্ধে স্থলপথে যুদ্ধের বিপরীতে জলপথে যুদ্ধ করেছিলেন ছিদ্দিক। কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, ২০১৩ সালে মেঘনানদীর ভাঙ্গনে লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরের ২ং সাহেবেরহাট ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড থেকে ভিটেমাটি হারিয়ে এখন বসবাস করছেন একই উপজেলার লরেন্স ইউনিয়নের করইতলা বাজারের পশ্চিম পাশে। এ নিয়ে দৈনিক আনন্দবাজারের প্রতিনিধি জুনাইদ আল হাবিব এর সঙ্গে একান্ত আলাপনে তুলে ধরেছেন তার যুদ্ধকালীন নানান স্মৃতি। সেসময়কার সব কিছুই মনে আছে স্বীকৃতি না পাওয়া জলপথের এই মুক্তিযোদ্ধার।

“৫২তে যখন ভাষার জন্য আন্দোলন হয়, তখন আমি ঢাকায় ছিলাম, মিরপুর-১ এ। বড় ভাই ইউনুসের সঙ্গে রাজমিস্ত্রী কাজ করতাম সেখানে। ৪৮সালে যখন কায়েদে আজম জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে বলছিলো, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। তখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা “নো নো” স্লোগান দিছে। ওই সময় বিহারীরা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু আর ইংরেজিতে ঘরের সাইনবোর্ড নামকরণ করতো। তারা পোস্টার লাগাত। আমরা তখন প্রতিবাদ করে পোস্টার ভেঙে পেলে দিতাম। এ জন্য আমাকে ৫ বার জেলে নেয়া হয়েছে। জেলে নিলেই ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াছ মোল্লা এমপির বাবা হারুণ মোল্লা আমাদের জেল থেকে ছুটাইয়া আনতো। আমাদের বেশিক্ষণ আটকাইয়া রাখতে পারতো না, খালি মোল্লা খবর পাইলেই হইত। বিহারীরা আমাদের বলতো, বাঙালি ভুত, আমরা বলতাম, শালা মারুয়া। এটা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে চরম দ্বন্ধ হতো৷ তখন তারা পুলিশ দিয়া আমাদের গ্রেপ্তার করাইতো। এভাবেই দেশের প্রতি টান বাড়ে। তারপর ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিই। ৭০’এর নির্বাচনে জগবন্ধুতে মাত্র একটা ভোট কেন্দ্র ছিল, ভোট দিছি। আমরা গান গাইতাম, “আমাগো দেশের ধান-চাউল পশ্চিমারা খায়, আমাগো দেশে টান হড়লে ভুট্টাদি বুঝায়”।

তিনি আরো বলেন,বঙ্গবন্ধু যখন ৭মার্চের ভাষণ দেন, তখন আমি রেসকোর্স ময়দানে আম গাছের উপর উঠে বঙ্গবন্ধুরে দেইখছি, ভাষণ শুইনছি। এখন যদি কেউ বলে, আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছি রেসকোর্স ময়দানে। তখন আমি বলি, বঙ্গবন্ধু কিসের উপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিছেন?স্টেজটা কিসের ছিল? এটা প্রশ্ন করলে অনেকেই উত্তর দিতে পারে না। তখন বাঁশ দিয়ে নৌকার আদলে স্টেজটা সাজানো ছিল। তার উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার তখন বাস বন্ধ করে দিছেন। আমরা রেসকোর্স ময়দান থেকে হাঁটতে হাঁটতে মিরপুর চলে যাই। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলছিলেন, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি, তখন তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়া শত্রুর মোকাবিলা কর। ২৫শে মার্চ রাতে আমি মিরপুরে। গভীর রাতে উপর থেইকা প্লেনে জলকামান দিয়া গরম পানি ছিটছে। তারপর সেখানে থাকতে পারি নাই। তারপর সেখান থেকে আমরা আবদুল হাই চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় মিরপুর আমিন বাজার চলে যাই। উনি বললেন, দ্যাখ, ঢাকারতো পরিস্থিতি খারাপ, তোরা দেশে চলে যা। তখন আমরা বললাম, আমরা কিভাবে যাবো? তখন উনি বললেন, আমি সে ব্যবস্থা করে দেব। তখন গাবতলী রূপালী ব্যাংকে বড় ভাইয়ের একাউন্টে টাকা জমা ছিল। ভাই ছিলেন, রাজমিস্ত্রীর সাব-কন্ট্রাক্টর। সেখান থেকে ১লাখ ৬৫ হাজার টাকা নিয়া মাথায় আসছিলাম। তখন বিহারীরা একদল আইসা, আমাদের থেকে সব টাকা নিয়া গেছে। আমাদেরও হাত-পা বেঁধে নিয়া গেছে। গাবতলী মাজার রোডের সেকেন্ড কলোনিতে নিয়া এক ঘরে আমাদের বন্দি করে রাখছে। তারপর যখন বেলা সন্ধ্যা হয়, তখন একজন জল্লাদ হাতে রামদা নিয়া আসছে আমাদেরকে কাটার জন্য। আল্লাহর রহমতে যে জল্লাদ, সে জল্লাদই আমাদের সাইডের মেস্তুরী ছিল। সে এসে আমাদের দেখে, আমাদের গলা ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিছে।

তার কাছে আমার ভাই বললো, আমরাতো শেষ। আমাদের সব কিছু নিয়া গেছে। তখন জল্লাদ বললো, তোদের টাকা পয়সাতো আর আমি দিতে পারবো না। তো, তোদের জানটা অন্তত বাঁচাতে পারবো। তারপর তিনি আমাদের নিয়া বুড়িগঙ্গা ব্রীজ পার করে আমিন বাজার পৌঁছাই দিছে। তারপর আমরা কান্নাকাটি শুরু করি। তারপর ওই চেয়ারম্যান এসে কথাবার্তা বলে শান্ত্বনা দেয়। তারপরের দিন বিকাল পাঁচটার সময় চেয়ারম্যান টাকা ১’শ দিয়া, নিজের গাড়িতে করে আমাদের সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছে দেন। তখন সন্ধ্যা ৬টার সময় লঞ্চে আমরা চাঁদপুর আইসা পড়ি। এখানে এসে দেখি, সব পাঞ্জাবিরা” আমার ভাই বলে, সর্বনাশ। এখান দিয়েতো যাওয়া যাবে না। তারপর ছোট খেয়া একটা দিয়া আমরা চাঁদপুরে দক্ষিণ পাশে চলে যাই।ভাগ্য ভালো, আমাদের এলাকার জারির দোনা খালের একটা নৌকা পাই আমরা। ওই নৌকা দিয়া আমরা চর কটারিয়া, আমাদের ভাওয়াল ঘরে চলে আসি। তারপর বাড়িতে আসি। তখন আত্মীয়-স্বজন, গ্রামবাসী ছুটে আসে আমাদের দেখতে। ঢাকায় কি ঘটছে, কিভাবে আসলাম আমরা, বিস্তারিত আমাগো থেকাই জানছে।

আমরা যারা নৌকার মাঝি ছিলাম, অন্ধকার রাতে জাহাজের চলাচলের রয়া বাতি নষ্ট করিয়া দবছি৷ যার কারণে, জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এই কারণে আর পাক বাহিনীরা নদী থেকে উপরের দিকে আসতে পারেনি। তখন অসংখ্য জাহাজের অস্ত্র, কামান, গোলাবারুদ আটকে যায়। তারপর ভারতের ইন্ধিরা গান্ধী যুদ্ধ বিমান দিয়ে বোমা ফেলে এসব জাহাজ ধ্বংস করে ডুবিয়ে দিছে। এতে বলতে গেলে তাদের হাত-পা ভেঙে গেছে৷ এ কারণে আমি বলবো, এটা শুধু দক্ষিণাঞ্চল না, সারা বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি কমেছে।

বুদ্ধিটা কোথায় থেকে আসলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে আমাদের এই বুদ্ধিটা ছিল না। আমরা উপরে যুদ্ধ করেছি। যখন আমরা রেডিওতে শুনি যে, স্থলপথে মুক্তিবাহিনীরা রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ উল্টাইয়া ধ্বংস করে দিছে। তারপর পাকবাহিনীদের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সেই রেডিও সেট আমার কাছে এখনো আছে। এখনো সেই রেডিওতে আমি বিবিসি, ভয়েস অব অ্যামেরিকাসহ অন্যান্য রেডিও শুনি। তখন আমরা ভাবতে থাকি, স্থলপথ বন্ধ হলো, জলপথ বন্ধ করবো কিভাবে? তখন আমাদের মাথায় আসলো, জলপথ বন্ধ করতে হলে, জাহাজের বয়া বাতি নষ্ট করতে হবে। রাতের আঁধারে গিয়া বয়াগুলো পিটাইয়া, লাঠি-কুড়াল দিয়ে মেঘনা নদীতে ফেলে দিতাম। নোয়াখালী আর ভোলার মধ্যে মেঘনা নদীর দূরত্ব ছিল ১৬কিলোমিটার। তারপর থেকে এভাবে জলপথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন তাদের ইঞ্জিনিয়াররা দিনে এসে দেখতো, বয়ার বাতি নাই বা বয়াও নাই। তখন তাদের নেভি জাহাজ দিয়া বয়া ঠিক করে যেত। তারপর আমরা আবার রাতে গিয়ে নষ্ট করে দিতাম। আমরা যারা এ কাজটা করতাম, উপরের কাউকে এইসব জানাইতাম না। আমরা ৫০জনের একটা দল ৫টা নৌকা নিয়া যাইতাম।

কাদের কাদের সাথে যুদ্ধ করছিলেন জানতে চাইলে মো. ছিদ্দিক বলেন,, জীবত আছি ধরেন আমি, আনোয়ার আলী মাঝি, আনোয়ার আলী কোম্পানি, খুরশিদ মাঝি, দুলাল মাঝি, ছিদ্দিক মাতাব্বর। আর মারা গেছেন আমার বড় ভাই ইউনুস, আছমত আলী সর্দার, আবদুস শহীদ, মো. শহীদ নলী, সৈয়দ মাঝি, সুলতান মাঝি, মজ্জল মাতাব্বর। এদের কথা আমার খেয়াল আছে। এরা সবাই চর জগবন্ধুর এবং সবাই নদীতে মাছ ধরতো, জেলে।

ক্ষোভ প্রকাশ করর মো. ছিদ্দিক বলেন, আমরা কি পাইলাম বা না পাইলাম, সেইটা বড় কথা না। দেশের জন্য আমি কি করলাম, সেইটা বড় কথা। আমাকে স্থানীয়ভাবে সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জানে। আমি আওয়ামীলীগ করতাম, বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের যে কার্ড দিয়েছেন, সে কার্ড এখনো যত্নে করে রেখেছি। আমি স্কুলের অভিভাবক কমিটিতে আছি। যখন আমি স্কুলে যাই, সবাই আমাদের জন্য এই দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে সম্মান দেয় । তখন কি বলবো, বলার ভাষাটা হারিয়ে ফেলি। কারণ, ভিতরের ক্ষোভটা ভিতরেই আছে। এসব বলে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফেলেন মুক্তিযোদ্ধা মো. ছিদ্দিক। বললেন, স্বাধীনতার আজ এত বছর। কিন্তু আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। আমি আর কিছুই চাইনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক’দিন আগে সংসদে বলেছেন, আমি রেডিওতে শুনেছি, উনি বলেছেন, সবাই স্থলপথে যুদ্ধ করেছেন। জলপথে কারা যুদ্ধ করেছে? একন আমার প্রশ্ন, আমরা যারা জলপথে যুদ্ধ করেছি, তাদেরতো কেউ একটু খোঁজ খবরও নেয় না। জীবনের শেষবেলায় এসে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা যেন স্বীকৃতি পাই।

আনন্দবাজার/শাহী/হাবিব

সংবাদটি শেয়ার করুন