বৃহস্পতিবার, ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাপ্তাই যুবলীগ সভাপতি নাছিরের বিরুদ্ধে অপকর্মের যত অভিযোগ

দলের পদ যেন আলাদীনের চেরাগ। পেশিশক্তি আর অস্ত্রের ক্ষমতা কিংবা টাকার বিনিময়ে একবার পদ পেলেই আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় না। সব অপকর্ম করে সহজেই পার পাওয়া যায়। কমতি থাকেনা বাড়ি, গাড়ি, প্রভাব, প্রতিপত্তি কোনো কিছুরই। ডাকাতি -রাহাজানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কাঠ পাচার, ভূমি জবরদখল, অস্ত্র – মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও অনৈতিক অপকর্ম করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া কেবলমাত্র ওয়ান-টুর ব্যাপার। টার্গেট একটাই দলীয় পরিচয় বা পদ ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে টাকা ইনকাম করা। তেমনই এক যুবলীগ নেতা মোঃ নাছির উদ্দীন।

পর্যটন নগরী কাপ্তাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতি পরিচয়ে উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান নাছির উদ্দীনের ত্রাসের রাজত্ব চলছে কাপ্তাই উপজেলা জুড়ে। চাঁদাবাজি, বনভূমি দখল, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য দিবালোকে ত্রাস সৃষ্টি করে সবই করছেন যুবলীগের সভাপতি এই নাছির উদ্দীন। এনিয়ে ভুক্তভোগী মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

এতদিন নাছিরের একক কর্তৃত্বেই চলেছে উপজেলার সবকিছু। তাই সবকিছু জেনেও তার অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায়নি কেউ। সাম্প্রতিক গাছ চুরির মামলায় রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর থেকে সবাই তার অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে।উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. নাছির উদ্দিনের অপকর্মের কথা এখন উপজেলার মানুষের মুখে মুখে। নাছিরকে বহিষ্কারের বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছলে তারা উৎফুল্ল হয়ে উঠেন।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে কাপ্তাই ‘প্রশান্তি’ নামের বনবিভাগের পিকনিক স্পট সন্ত্রাসী কায়দায় জোর করে দখলে নেয় নাছির। ওই সময় নাছিরের সন্ত্রাসী বাহিনীর বাধার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগ অফিসে দরপত্র দাখিল করতে পারেনি চট্টগ্রাম থেকে আসা ৫-৬ জন ঠিকাদার। এমনকি নাছির যুবলীগের প্রভাব কাটিয়ে দরপত্রের বাক্সও ছিনিয়ে নেয়। ওই সময় দরপত্র দাখিল করতে যাওয়া দু’একজন ঠিকাদারকেও পুলিশের সামনে মারধর করে নাছির। ঘটনাটি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে।

আরও পড়ুনঃ  মাধবপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় চানারুঘাট পৌর ছাত্রলীগ সভাপতি নিহত

অভিযোগ রয়েছে বনবিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাও নাছিরের রোষানলের শিকার হয়েছেন। তিনি অস্ত্রের জোর দেখিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনকে মারধর করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেত না। বনবিভাগের পিকনিক স্পট ‘প্রশান্তি’তে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে মর্মে একাধিকবার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার না পাওয়ায় চুপসে যায় স্থানীয়রা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা নাছির ‘দরপত্র’ ছিনিয়ে নেওয়ার পর প্রশান্তিকে বানিয়েছে তার টর্চার সেল। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে টর্চার সেলে নিয়ে এসে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। শুধু তাই নয়, প্রতিরাতে এখানে ক্যাসিনো স্ট্যাইলে বসে জুয়ার আসর। গভীর রাত পর্যন্ত তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা এবং অসামাজিক কার্যকলাপসহ নানা অপকর্ম চলাতো এই পিকনিক স্পট প্রশান্তিতে।

এই প্রশান্তিতে বসে নাছির রাতের আঁধারে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অবৈধ কাঠ পাচার, বনভূমি দখলে, ডাকাতি -রাহাজানি, চাঁদাবাজির, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, জবরদখল আধিপত্য বিস্তারে নানা অপকর্ম ঘটাচ্ছে। এসব অপকর্মের জন্য রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। এর আগে বন বিভাগের প্রায় ৩০ লাখ টাকার বনজ সম্পদ আত্মসাতের একটি মামলায় জেল খেটেছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, গত ২৮ জানুয়ারি বন বিভাগের মামলায় রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নাছির উদ্দিনকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত। একইসঙ্গে তাকে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন আদালত। একই মামলার আরেক আসামি রাহুল তংচংগ্যা ওরফে বাবুল মেম্বারকে দেড় বছর সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে দুই মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনঃ  কাপ্তাইকে করোনা মুক্ত রাখতে যাদের ভুমিকা অনন্য

উপজলো নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহান জানান, গত ২৮ আগস্ট বুধবার তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এই চিঠি পেয়েছেন। চিঠিতে কাপ্তাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নাছিরকে উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানানো হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু তার বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলায় তিন বছরের সাজার একটি আদেশ হয়েছে, সে কারণে তাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়কিভাবে বরখাস্ত করেছে।’

এ বিষয়ে নাছির উদ্দিন বলেন, ‘এসব মিথ্যা মামলা। এসব দলীয় গ্রুপিং ও প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র। এই মামলায় জেল খেটেছি, আপিল করেছি। ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্তের বিষয়টি শুনেছি, তবে কোনো নোটিশ পাইনি।’

এব্যাপারে রাঙ্গামাটি জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পদক নূর মোহাম্মদ কাজল বলেন, ‘নাছির উদ্দিন উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। সেখানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

আনন্দবাজার/শাহী/মতিন

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন