গত তিন বছর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণে বাঁচতে টেকনাফের ১২টি পয়েন্ট দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গারা। ওই সময় কক্সবাজারের উখিয়া- টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের ভিটেমাটি এমন কি ঘরবাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল নির্যাতিতা রোহিঙ্গাদের।
বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। তাদের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়। এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।
গত তিন বছরে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যবাসান নিয়ে মাঝে মধ্যে বেশ তোড়জোড় হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি এখন পর্যন্ত। শুধু চুক্তি আর চিঠি আদান- প্রদানেই সীমাবদ্ধ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার এক সঙ্গে ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বদরবারে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও ভালো নেই সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে অনেকেই হারিয়েছে সহায়-সম্বল, ফসলি জমি। এমনকি ভিটে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ায়র অভিযোগ অনেক।
স্থানীয়দের অভিযোগ তাদের সন্তান স্কুলপড়ুয়া শিশুদের পর্যন্ত কারণে অকারণে রোহিঙ্গারা দলবেঁধে এসে মারধর করা এখন ক্যাম্পের নিত্যদিনের চিত্র। স্থানীয় শিশুরা ঠিকমত খেলাধুলা করতে পারে না। ক্যাম্পের আশেপাশে খেলতে দেখলে রোহিঙ্গাদের একদল এসে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়াটা যেন রোহিঙ্গা যুবকদের জন্য একধরনের গৌরবের।
স্থানীয়দের দাবি কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করলে রোহিঙ্গারা দলবেঁধে স্থানীয়দের পিটিয়ে উল্লাস করে। তুচ্ছ কারণে হামলা করে স্থানীয়দের উপর।এমন কি স্থানীয়দের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মারধর করার ঘটনা ঘটেছে।স্বদেশ তাড়িত এই জাতির কারণে বাড়ছে খুনাখুনি। সুখশান্তি বিনষ্ট হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। যতই সময় গড়াচ্ছে রোহিঙ্গা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
আমেনা বেগম নামের এক বায়োবৃদ্ধা মহিলা বলেন,জান্নাত পাবার আশায় সহায় সম্বল যা ছিলো তার সবই রোহিঙ্গাদের দান করে দিয়েছি। যাদেরকে দান করেছি, তারাই এখন আমাকে আমার ভিটেমাটি দখল করে নিয়ে তাদের আত্মীয়দের নিয়ে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে চরম ভুল করেছি, তারা আসলে অমানুষ ও অকৃতজ্ঞ।
স্থানীয় নুরুল বশরের দাবি শুধু আমেনা বেগম নয় স্থানীয় কয়েক হাজার পরিবার রোহিঙ্গাদের কারনে ঘরবাড়ি ও এলাকা ছাড়া। নুরুল বশর জানিয়েছেন, উখিয়ার পালংখালী ও কুতুপালংয়ের কয়েকটি ক্যাম্পের এলাকা থেকে কমপক্ষে দুই হাজার মত পরিবার রোহিঙ্গাদের কারনে উচ্ছেদ ও অত্যাচারের কারনে এলাকা ছেড়েছেন।
একই অভিযোগ হোস্ট কমিউনিটির স্থানীয় ২৫০পরিবারের সভাপতি মাহফিজুর রহমানের।তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের মারধরসহ নানান ধরনের অত্যাচার করে চলছে। রোহিঙ্গাদের কারনে কয়েকটি ক্যাম্পে বসবাসরত ৮০০মত পরিবার বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ হয়েছে। কেউ বা রোহিঙ্গা কতৃর্ক ছেলে মেয়ে অত্যাচার সয়তে না পেরে এলাকা ছেড়েছে।মাহফিজুর রহমানের দাবি তার আম বাগানসহ ৬০কানি মত জায়গা রোহিঙ্গারা দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন উখিয়া উপজেলার নিবার্হী কর্মকর্তা ইউএনও নিকারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কারনে অনেকে ফসলি জমি ও দখলে থাকা পাহাড়ি জমি হারিয়েছেন এটি সত্য। তিনি বলেন,রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা গুলো সরকারি জায়গা হলেও স্থানীয়দের দখলে ছিল তারা চাষবাদ করত।কিন্তু রোহিঙ্গা ঢল আসার পর সেখানে রোহিঙ্গাদের বসতি ও এনজিও সংস্থা গুলো তাদের অফিস নির্মাণ করেছে।তবে সবসময় প্রশাসন স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিয়েছে।
কয়েক হাজার স্থানীয় পরিবার উচ্ছেদ প্রসঙ্গে নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারনে পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। তাই যাদের টাকা পয়সা আছে, ভালো পরিবেশে থাকতে চান তারা অথবা ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার প্রয়োজনে অনেকে স্বপরিবারে শহরে চলেগেছে বলে জেনেছি। তবে কোন পরিবারকে উচ্ছেদ বা তাড়ানো হয়েছে এমন অভিযোগ কেউ করেননি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, বিশাল জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। এর পরও তাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিরলসভাবে কাজ করছে পুলিশ।
তার দেয়া তথ্যমতে গত তিন বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছেন এক হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ৫৩টি খুন, ৪১০টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৫৯টি অস্ত্র, ৩৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ১৬টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা উল্লেখযোগ্য।
তবে চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতার কারনে রোহিঙ্গাদের অপরাধ কিছুটা কমে এসেছে। এ কারণে মামলার সংখ্যাও কমেছে বলে জানিয়েছেন ইকবাল হোসাইন।
আনন্দবাজার/শাহী/জসিম