ঢাকা | রবিবার
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের ম্যাকিয়াভেলিয়ান ‘প্রিন্স’

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক ছাত্রনেতা শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম শেখ নূরুল হক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর বড় বোন।

শেখ ফজলুল হক মনি ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৬০ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ষাটের দশকে সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি সাহসী নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন।

শেখ মনি সম্পর্কে কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন- সেই একটা সময় ছিল; ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতিতে তাদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন, তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল।

রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তারা দেশের মানুষকে ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়ি ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি ভাই এই দলের মানুষ; মতান্তরে গিয়ে দাঁড়ায়নি কখনও। মনি ভাইকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর শেখ মনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন।

‘দৈনিক বাংলার বাণী’ ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন- শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালের অন্যতম সম্পাদক ও প্রণেতা ছিলেন। আজ হয়তো ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা বন্ধ; কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, কলাম লেখক, ছোট গল্পকার ও তাত্ত্বিক দার্শনিক।

ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পুরোধা। তার প্রতিষ্ঠিত সুস্থ বিনোদনধর্মী সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা বাঙালি সংস্কৃতির পরিশীলিত বুনিয়াদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী যুবসমাজকে সৃজনশীল ও আদর্শ দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে।

আমাদের দুঃখ ও কষ্টের জায়গা একটাই- কোনো নিরাপত্তা দিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও মনি ভাইকে ধরে রাখতে পারিনি। তবে তার চিন্তা ও দূরদর্শিতা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলেই তাকে স্মরণ করা সার্থক হবে। শেখ মনি এবং বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কটা ছিল যেন আত্মার সঙ্গে আত্মার।ঘাতকরা জানত, বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করতে হলে শেখ মনিকে আগে আঘাত করতে হবে।

শেখ মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই দুইবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনিও ছিলেন কারা নির্যাতিত নেতা। আইয়ুব খান-মোনায়েম খান তাকে ব্যক্তিগতভাবে বড় শত্রু হিসেবেই চিনতেন। ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মনি ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার কুলাঙ্গার মোনায়েম খানের হাত থেকে সার্টিফিকেট না নেয়ার আন্দোলনে শেখ মনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যারা মোনায়েমের হাত থেকে উপাধিপত্র নেয়ার জন্য সভাস্থলে হাজির হয়েছিলেন, তারা উল্টো শেখ মনির নেতৃত্বে সভাস্থল বয়কট করেন, মোনায়েম খানকে প্রকাশ্যে বর্জন করেন। উপাধিপত্র না নিয়েই তারা ফিরে যান। এতে ক্রুদ্ধ মোনায়েম খান ক্ষমতার বলে শেখ ফজলুল হক মনির ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিনি ডিগ্রি ফিরে পান।

শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ১৯৬৬ সালের ৭ জুনে ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করে তোলা। তিনি তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পিছিয়ে যেত। মোনায়েম খান শেখ মনিকে গ্রেপ্তার করেন; তিনি মুক্তি পান ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর।

শেখ মনি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচির অন্যতম প্রণেতা। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক-বীমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ ভাগ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। (স্মরণীয়-বরণীয়, ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়-পৃ:৪৬১)।

শেখ মনি ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিউক্লিয়াস বাহিনীর পরিকল্পক ছিলেন, তেমনি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিব বাহিনী গঠনের অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। এই ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। আজ বুঝতে পারি, কেন মনি ভাই মুজিব বাহিনী গঠন করে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। গোলাম আযমও যখন ভাষা সৈনিক, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যখন মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি ‘বীর উত্তম’ তখন মুজিব বাহিনী গঠনের প্রয়োজন ছিল বৈকি?

কোনো নিরাপত্তা দিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধু,তার পরিবার ও মনি ভাই,তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কে ধরে রাখতে পারিনি। তার চিন্তার দূরদর্শিতা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলেই তাকে স্মরণ করা সার্থক হবে৷

কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা এন আই আহমেদ সৈকত এর ফেসবুক ওয়াল থেকে

আনন্দবাজার/শাহী

সংবাদটি শেয়ার করুন