ঢাকা | বৃহস্পতিবার
১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্ত প্রায় ২৩ প্রজাতির মাছ যেভাবে ফিরিয়ে আনা হলো

দেশে গত এক দশকে ‘প্রায় বিলুপ্তি’র মুখ থেকে ফিরে এসেছে এমন দেশি মাছের সংখ্যা ধিরে ধিরে বাড়ছে। প্রাকৃতিক এবং বাণিজ্যিক চাষ উভয়ভাবেই বাড়ছে মাছের উৎপাদন।

যদিও গত কয়েক দশকে ১০০’র বেশি দেশি প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

তবে বাংলাদেশে গত এক দশকে মাছের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থা এফএও’র ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই মূহুর্তে মিঠা পানির মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে আছে।

সরকারি হিসাবে দেখা গেছে বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপাদন করছে।

কিন্তু এর বড় অংশটি ইলিশ।

ফিরে আসা মাছেরা

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২০’ নামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাদু পানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে আছে।

আইড় মাছ

বছরে ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের মিঠা পানির মাছের উৎপাদন।

এ হারে প্রথম অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ায় ১২ শতাংশ হারে উৎপাদন বাড়ছে মিঠা পানির মাছের।

গবেষকেরা জানিয়েছেন, ‘প্রায় বিলুপ্ত’ অবস্থা থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফিরে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে হাওড় অঞ্চল ও মেঘনা নদীর অববাহিকায়।

এর বাইরে গবেষণার মাধ্যমে ফেরানো হয়েছে কিছু প্রজাতির মাছ, যেগুলো এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, মোট ২৩টি প্রজাতির মাছ পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে, এগুলো হচ্ছে—

১. পাবদা

২. গুলশা

৩. টেংরা

৪. শিং

৫. মাগুর

৬. গুজি আইড়

৭. চিতল

৮. ফলি

৯. মহাশোল

১০. বৈরালী

১১. রাজপুঁটি

১২. মেনি

১৩. বালাচাটা

১৪. গুতুম

১৫. কুঁচিয়া

১৬. ভাগনা

১৭. খলিশা

১৮. বাটা

১৯. দেশি সরপুঁটি

২০. কালিবাউশ

২১. কই

২২. গজার

২৩. গনিয়া

এর বাইরে প্রাকৃতিক উপায়েও মাছের উৎপাদন বেড়েছে, মূলত হাওড় অঞ্চল এবং মেঘনা নদীর অববাহিকায়।

চিতল মাছ ছবি

ওইসব এলাকায় রিটা, আইড়, বাগাইড়, নদীর পাঙ্গাস, শিলন, চিতল এবং দেশি সরপুঁটি মাছের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিস।

কিভাবে ঘটেছে এই প্রত্যাবর্তন
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই ২৩টি প্রজাতির মাছকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

এখন আরো ৭টি প্রজাতি নিয়ে গবেষণা চলছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশে এই মূহুর্তে ৮০০ হ্যাচারিতে মাছের পোনা চাষ করা হয়, ২০০৮ সালে দেশে হ্যাচারির সংখ্যা ছিল ২৫ টির মত।

“বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে হাওড়-বাঁওড়, খাল, বিল, পুকুরসহ জলাশয়ের সংখ্যা বহুলাংশে ছোট হয়ে গেছে।

এই কারণে হারিয়ে যাচ্ছিল মিঠা পানির মাছের বহু প্রজাতি। ফলে গবেষণার মাধ্যমে সেগুলো আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়, যার ফল বর্তমানে বাজারে গেলে টের পাওয়া যায়।”

শিলন মাছের ছবি

তিনি বলেন, একেকটি মাছের প্রজাতি নিয়ে গবেষণায় সাফল্য পেতে অন্ততপক্ষে আড়াই থেকে তিন বছর সময় লেগেছে।

মি. মাহমুদ জানান, পুনরায় ফিরিয়ে আনা মাছগুলো ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ চলছে।

বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হওয়া মাছের মাঝে পুকুর এবং ডোবার মত বদ্ধ জলাশয়ে ৫৭ শতাংশ মাছ উৎপাদন হচ্ছে।

দেশে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।

প্রাকৃতিক প্রত্যাবর্তন
বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিসের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের হাওড় ও উজানে প্রাকৃতিকভাবে গত এক দশকে মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বেড়েছে।

এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, হাওড় অঞ্চলে জলাশয় ইজারা দেবার সরকারি পদ্ধতি বাতিল হবার কারণে এ অগ্রগতি হয়েছে।

“ইজারা পদ্ধতি চালু থাকাকালে জলাশয়ের ব্যবহারকারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু আচরণ যেমন মৌসুম শেষে জলাশয়টি পুরোপুরি সেচে ফেলা, রাসায়নিক ব্যবহার এসব কারণে মাছের প্রাকৃতিক আবাস ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হত।”

দেশি সরপুঁটি ছবি

তিনি বলেন, এখন নতুন নিয়মে কোন নির্দিষ্ট কম্যুনিটি একটি জলাশয়ের দায়িত্ব পায়, সেখানে মাছের আবাস ও উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের দেয়া নিয়মাবলী মানা হচ্ছে কিনা তা মনিটর করতে হবে।

“এর ফলেই মাছের আবাসস্থল অথবা হ্যাবিটাট অটুট থাকছে, ফলে মাছের প্রজনন নির্বিঘ্নে হতে পারছে।”

মি. মহালদার বলেন এর বাইরে মাছের জন্য অভয়াশ্রম করা হয়েছে অনেক অঞ্চলে, হাওড় অঞ্চলে পুনরায় খনন করে মাছের আবাসস্থল ফেরানো হয়েছে কোন কোন এলাকায়।

“এছাড়া ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বছরে কয়েকটি সময় যে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, এর কারণে কেবল ইলিশই বাঁচে না।

ওই একই আবাসস্থলে থাকা রিটা এবং আইড়ের মত মাছও সুরক্ষা পাচ্ছে। যেমন একটি নির্দিষ্ট সময় ইলিশ ডিম ছাড়ছে ও বাচ্চা ফুটছে মানে প্রচুর জাটকা হচ্ছে, এই জাটকা আবার রিটা ও আইড়ের প্রধান খাবার।”

তবে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপক হারে হচ্ছে বলে, রিটা এবং আইড় মাছের পেটে অনেক জাটকা চলে যাবার পরেও সব কটি মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিলুপ্ত-প্রায় অবস্থা থেকে ফেরা কি স্থিতিশীল?
বাংলাদেশে দেশীয় মাছের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০।

রিটা মাছছবির

এর মাঝে প্রায় বিলুপ্তির পথে ১০০র বেশি দেশীয় মাছ থাকলেও সেগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন’এর এ সংক্রান্ত নিয়ম হচ্ছে, সর্বশেষ কোন একটি প্রজাতির মাছের দেখা পাবার পরবর্তী ২৫ বছরে যদি সেই প্রজাতির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

যার ফলে বিলুপ্ত ঘোষণা না হলেও বহু দেশিয় মাছই এখন আর দেখা যায় না।

ব্যাপক হারে চাষাবাদ হবার ফলে এসব মাছের দামও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে, যার কারণে একদিকে দেশিয় উদ্যোক্তাদের যেমন কর্মসংস্থান হচেছ, তেমনি অর্থনীতির উন্নয়নও তো হচ্ছে।”

আনন্দবাজার/এফআইবি

সংবাদটি শেয়ার করুন