ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কক্সবাজার সৈকতে বিষাক্ত বর্জ্য; রহস্য উদঘাটন করলেন জেলেরা

বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে জনশূন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের তিন দশক পর প্রাণ-প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যের দেখা মিলেছে। তবে তা বেশিদিন আর স্থায়ী হলো না। বর্তমানে কক্সবাজার সৈকতের প্রায় ৩০ কিলোমিটার জুড়ে সর্বত্র বিষাক্ত বর্জ্যের সয়লাব।

জানা গেছে, গত ১০ জুলাই থেকে হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে সৈকতে ভেসে আসছে শত শত টন প্লাস্টিকের বর্জ্য, মদের বোতল, ছেঁড়া জালসহ নানান রকম বর্জ্য। ছেঁড়া জাল ও বর্জ্যে আটকে পড়ে মারা যাচ্ছে সামুদ্রিক কাছিম ডলফিনসহ নানান প্রাণী। এতে কক্সবাজার সৈকতের পরিবেশ মারাত্মক দূষণ ও হুমকির মুখে পড়েছে।

কক্সবাজার সৈকতে প্রথম বর্জ্য ও মদের বোতল অবিষ্কার করেন প্লাস্টিক ব্যাংক বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠাতা সাকের আলম জানান, গত ১০জুলাই থেকে তারা সৈকতে প্লাস্টিক সংগ্রহে অভিযানে নামেন। মানব শূণ্য সৈকতে নেমে শত শত টন বর্জ্য ও মদের বোতল অবিশ্বাস্য স্তুুপ দেখতে পান।

বিষয়টি নিয়ে সাকের আলম ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তারিত তুলে ধরে পোস্ট দিলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কক্সবাজার সৈকতে ভেসে আসা ভয়াবহ পরিবেশ বিনষ্টকারী ও দূষণ সৃষ্টিকারী প্লাস্টিকের নানান পণ্যের বর্জ্য ও মদের বোতল গুলো বেশিরভাই বিদেশী কোম্পানীর তৈরি পণ্য। এসব পণ্য সাধারণত বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না বলে জানিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন গুলো ও স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন গুলো বলছে, এসব বিষাক্ত বর্জ্য গুলো পাশ্বর্বতী দেশ থেকে আসতেছে এইটা নিশ্চিত।তবে ইচ্ছাকৃতভাবে এসব বর্জ্য বাংলাদেশের দিকে ঢেলে দেয়া হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে পরিবেশ বান্ধব পরিছন্ন সৈকত গড়ার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠন গুলো।

কক্সবাজার সৈকতের বিষাক্ত বর্জ্য নিয়ে জোর আলোচনা চলছে জেলেদের মাঝেও। জেলেরা বলছে, এসব বর্জ্য পাহাড়ি ঢলে পাশের দেশ ভারত থেকে সরাসরি বঙ্গোপসাগর হয়ে কক্সবাজার সৈকতে আসছে।সাগরের একাধিক পয়েন্টে আরও হাজার হাজার টন বর্জ্য তারা দেখতে পেয়েছেন। এসব বর্জ্য ধীরে ধীরে কক্সবাজারের খুব কাছাকাছি চলে আসছে বলে জানিয়েছে জেলেরা।

জেলেদের নেতা শামশু আলম মাঝির দাবি, মেরিন ড্রাইভে এর পটোয়ারটেক পয়েন্টের মাত্র দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম এর মধ্যবর্তী কোণ দিয়ে বর্জ্যে জমাট বেঁধে বিশাল একটি রাম্তার মত দেখতে ভারতের তারিনা বিলার হয়ে কক্সবাজার সৈকতে এসেছে। একইভাবে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে পঁচাখালীর বাত্বি নামক একটি পয়েন্ট থেকে মিয়ানমার ঘেষে ভারতের দিকে একটি বর্জের দীর্ঘ স্তুুপ এবং সোনাদিয়া পশ্চিম দিক থেকে ভারত হতে পাহাড়ি ঢলে আরও একটি দীর্ঘ কিলোমিটারের বর্জ্যের স্তুুপ তারা দেখতে পেয়েছেন।

শামশু মাঝির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ভারী বর্ষণের ভারতের পাহাড়ি ঢলে একটু একটু করে বর্জ্য গুলো এসে জমেগেছে বঙ্গোপসাগরে। যা পানির উপর থেকে খেয়াল করলে যে কেউ বুঝতে পারবে। তিনি বলেন,সাগরের যেখানে বর্জ্যের স্তুুপ জমে আছে সেখানে পানি গুলো কালো দেখা যাচ্ছে।পাশাপাশি ডনফিন,কাশিমসহ নানান সামুদ্রিক মৃতদেহ সেখানে আটকে আছে।

জেলেদের তথ্য অবগত করে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্স ইনস্টিটিউট এর এনভায়রমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগ এর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু শরীফ মোঃ মাহবুব-ই-কিবরিয়া বলেন, কিভাবে কোথাথেকে এসব বিষাক্ত বর্জ্য আসছে সেটি জানতে বাতাস,পানি ও ঢলের স্রোতের পরিমাপ ও বর্জ্যের স্যাম্পল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বলা যাবে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ শুরু করেছে।

তিনি আরও বলেন, জেলের তথ্য গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, জেলেরা সাগরের যেসব স্থানে বর্জ্য দেখেছেন বলে তথ্য দিয়েছে প্রয়োজনে সেখানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারাও পরির্দশনে যাবেন।

আগামী দুই একদিনের মধ্যে এ বিষয়ে গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বসে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন নিজেদের মধ্যে পর্যালোচনায় করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

এদিকে প্রশাসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গত এক সপ্তাহ ধরে ১১টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনের প্রায় ৩ শতাধিক কর্মী সৈকতে বিভিন্ন পয়েন্টে বর্জ্য অপসারণের কাজ করছে। সৈকত থেকে বর্জ্য সম্পূর্ণভাবে অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে জানিয়েছে প্রশাসন।

কক্সবাজার জেলা মোঃ কামাল হোসেন বলেন, সৈকতে যদি বর্জ্য আরও আসে তা অপসারণের জন্য সেভাবে প্রস্তুুতি নেয়া আছে। আর বর্জ্য কিভাবে কোথাকে থেকে এলো তা তদন্ত চলছে।তদন্তকারী দলের প্রতিবেদন জমা হলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে।

আনন্দবাজার/শাহী/জসীম

সংবাদটি শেয়ার করুন