ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনিশ্চয়তায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতের ভবিষ্যৎ

একসময় শখের বশেই ফটোগ্রাফি করতেন নারায়ণগঞ্জের জনি হোসাইন। তাই পড়াশোনা শেষ করে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ফটোগ্রাফির আয় দিয়ে ভালোভাবেই চলছিল তার সংসার। কিন্তু করোনা মহামারীতে থমকে গেছে সব। গণজমায়েতসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধে বন্ধ রয়েছে তার আয়। লকডাউনের পর নিজের জমানো টাকা প্রায় শেষের পথে। তিনি এখন চিন্তিত নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

হূদয়, (ছদ্মনাম) বিভিন্ন ইভেন্টে নিয়মিত ছবি তুলতেন তিনি। সবকিছু ভালোই চলছিল। সময়ের সাথে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে সেটআপও বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারীতে ফিকে হয়ে গেছে হূদয়ের স্বপ্ন। কাজ বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সে। বাধ্য হয়ে শখের ক্যামেরা বিক্রি করে রাজধানীতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন।

জনি ও হূদয়ের মতো হাজারো তরুণ জীবিকা নির্বাহ করেন করপোরেট ইভেন্ট ও ওয়েডিং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে ফ্রিল্যান্সিং করে। তবে করোনাভাইরাসের মহামারীতে কাজ হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে রয়েছেন তারা।

জনি জানান, কাজের স্বাধীনতা থাকায় ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। শুরুর দিকে করপোরেট ফটোগ্রাফি করলেও পরেরদিকে শুধু ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতাম। এতদিন সব ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনার কারণে সবই বন্ধ। আগে প্রায় প্রতিদিনই ইভেন্ট থাকত। এপ্রিলেও অনেক বুকিং ছিল। সেগুলো বাতিল করেছি। বুকিং মানিও ফেরত দিয়েছি। সেভিং দিয়ে কয়েক মাস চলেছি। এখন সামনে কীভাবে চলব বুঝতেছি না। এত খারাপ অবস্থায় পড়ে যাব সেটা কখনই বুঝতে পারিনি।

জানা গেছে, বাণিজ্যিকভাবে দেশে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে। মূলত ২০০২ সালের পর থেকেই এটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে গত এক দশক ধরে ব্যাপক জনপ্রিয় নতুন ধারণার এ ব্যবসা। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিশাল আয়োজনের ট্রেড শো, যে অনুষ্ঠানই হোক না কেন কোনো ঝক্কি-ঝামেলার মুখোমুখি না হতে অনেকেই নির্ভর করছে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এ খাতের চাহিদা বাড়ায় পুরনোদের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই যুক্ত হয়েছেন এ ব্যবসায়। কিন্তু করোনার কারণে ছোট ছোট ইভেন্ট কোম্পানি এরই মধ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। আর পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে সংকটে পড়বে এ খাতের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান।

ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরে পাঁচ শতাধিক ছোট-বড় করপোরেট ইভেন্ট প্রতিষ্ঠান কাজ করে। আর ওয়েডিং ইভেন্ট প্রতিষ্ঠান আছে তিন শতাধিক। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে প্রায় ৩০০টির মতো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জেলার প্রতিষ্ঠানগুলো বিয়ে-করপোরেটসহ সব অনুষ্ঠানই আয়োজন করে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা বলেন, লকডাউনে কাজ না থাকায়, আমাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দিলেও আমাদের কোনো লাভ নেই। কারণ গত চার মাসে প্রায় ৩০ শতাংশ ছোট ছোট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী চার মাসে আরো ৩০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ এক বছর পর্যন্ত দেখবে।

তিনি বলেন, মানুষজনের সমাগম ছাড়া তো কোনো ইভেন্ট করা যায় না। আমাদের খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। অফিস বন্ধ চার মাস ধরে। লকডাউন খুললেও আমরা কোনো কাজ পারব না। কাজ পেতে পেতে ছয় মাস লেগে যাবে। মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো এক বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। সবকিছু স্বাভাবিক হলেই আমরা কোনো ইভেন্ট পাব না। কারণ মানুষ স্বাভাবিক হবে, তাদের কাছে টাকা-পয়সা আসবে। টাকা-পয়সা আসার পরই তারা ইভেন্ট শুরু করবে। মানে আরো ছয় মাস। খুললেই আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য হবে না।

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএমএমএবি) সাধারণ সম্পাদক ও স্কাই ট্র্যাকার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দোজা এলান জানান, চার মাস ধরে আমাদের অফিস বন্ধ। কারণ কোনো কাজ নেই। আর যেগুলো ছিল, সেগুলোও মহামারীর কারণে স্থগিত। বেশির ভাগ এজেন্সির পুরো প্যাক কাজ ছিল। এখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ছিল। এছাড়া আরো কাজ ছিল। সেটা পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আর সংগঠনটির সভাপতি ও অন্তর শোবিজের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরী মনে করেন, মুজিব বর্ষের কারণে এবার বছরটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতের জন্য সবচেয়ে লাকি বছর ছিল। তিনি বলেন, হাজার কোটি টাকার উপরে এ আয়োজনের বাজেট ছিল। এর প্রায় সব কর্মকাণ্ডই করত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টগুলো। কাজ করতে পারলে আমাদের সবারই লাভ হতো। কিন্তু করা হয়নি। অন্যান্য ব্যবসা খাতের কমবেশি আয় হচ্ছে, কিন্তু আমাদের জিরো।

খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রোজার মাসে এমনিই তাদের কাজ কম থাকে। তবে এ সময়ে ব্র্যান্ড প্রমোশন, করপোরেট ইফতারের আয়োজন করে থাকে। কিন্তু এবার সেটাও হয়নি। অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশি কাজ হয়ে থাকে। শীতের সময়ে অনেক কনসার্ট হয়ে থাকে। করোনার কারণে এসব বন্ধ হয়ে আছে। আর চলতি বছর কোনো ওপেন কনসার্ট আয়োজনেরও সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।

আনন্দবাজার/তা.তা

সংবাদটি শেয়ার করুন