এক সময়ের খরস্রোতা জলকদর খাল দখল আর দূষণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। খালের বুকে ঘরবাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ, বাঁধ দিয়ে অবৈধ মাছ চাষ, ময়লা আবর্জনায় পানি দূষণের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে এই খালে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটখাটো নৌকা যা চলতেছে তাও পানি প্রবাহ অবরুদ্ধ হয়ে চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বড় ধরনের লবণ বোঝাই বোট গন্তব্যে পৌঁছার উদ্দ্যেশ্যে ছাড়তে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতে করে বাঁশখালী থেকে অন্যান্য এলাকায় মালামাল পরিবহন হচ্ছে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সুবিধা-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বাঁশখালী জনপদের লাখো মানুষ।
জানা যায়, বাঁশখালীর বুক চিড়ে প্রবাহিত জলকদর খালটি বাঁশখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসায়ীদের অন্যতম মাধ্যম।দুঃখের বিষয় দীর্ঘকাল যাবত এই খালটি প্রভাবশালীরা গ্রাস করে খাচ্ছে। একদিকে প্রভাবশালীদের দখল অপরদিকে খালটি সংস্কার না হওয়ায় সরু হয়ে গেছে। এক সময় বাঁশখালীর মানুষ নৌকা ও সাম্পানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে এই খাল হয়ে সকল মালামাল নিয়ে আসতো শঙ্খ নদী হয়ে। এই খালটির দৈর্ঘ্য ৪৭ কিলোমিটার প্রস্থ্য ৬৭মিটার। জলকদর খালটি বাঁশখালীর সাধনপুর থেকে ছনুয়ায় গিয়ে বঙ্গোপসাগর প্রণালিতে গিয়ে মিশেছে।
রাজখালী, ছনুয়া, শেখেরখীল, পুঁইছড়ি, গন্ডামারা, সরল, খানখানাবাদ, শীলকূপ, বাহারছড়া ইউনিয়নের মধ্যবর্তী প্রবাহিত হয়ে আবারো সাধনপুরে গিয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গিয়ে মিশেছে। বাঁশখালীকে ২ভাগে ভাগ বিভক্ত করেছে এই জলকদর খাল। তা হচ্ছে পশ্চিম বাঁশখালী আর পূর্ব বাঁশখালী। তৎমধ্যে পশ্চিম বাঁশখালীর মানুষের পেশা লবণ চাষ ও মাছ ধরা। আর পূর্ব বাঁশখালীর মানুষের পেশা ব্যবসা ও ক্ষেত খামার করা।
তৎকালীন বিএনপি সরকার ও বর্তমান আ.লীগ সরকারের আমলে জলকদর খালের উপর দিয়ে জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য অর্ধশত ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। ৯১’র ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলকদর খালে একটা ব্রীজ না থাকায় পশ্চিম বাঁশখালীতে অসংখ্য মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে মারা যায়।
বর্ষাকালে বাঁশখালীর বেশিরভাগ পানি নিষ্কাশন হয় এই খাল দিয়ে। খালটির দু’পাশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টি হলে দু’তীরে বন্যার সৃষ্টি হয়ে বেড়িবাঁধ তলিয়ে যায় প্রতিবছর।অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে অহরহ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দূষণে-ভরাটে বাঁশখালীর মানচিত্র থেকে হারাতে বসেছে খালটি। খালটির উপর দিয়ে ভূমিদস্যুদের স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। ফলে স্বাভাবিক গতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় এখন প্রায় বন্ধ হয়ে নৌ চলাচল।
স্থানীয়দের দাবি, খালটি খনন করে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে নেওয়া ও দখল উচ্ছেদ করে প্রতিবন্ধকতা দূর করা। তাহলে এ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক লাখো মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
এব্যাপারে বাঁশখালী উপজেলা বিএনপির যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক সোলতানুল আজিম চৌধুরী এ প্রতিবেদককে বলেন, ”জলকদর বাঁশখালীর অনেক ঐতিহ্য বহন করে। এই খালের অনেক ঐতিহাসিক-বাণিজ্যিক ঘটনা রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে এই খাল অনেক ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। যা কর্তৃপক্ষের নজরে এনে বাঁশখালীর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যায়।”
তিনি আরো বলেন, ”এ বিষয়টি ভূমিমন্ত্রী ও হাইকোর্টের নজরে আনা যায়। তাহলে কোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দিতে পারে। ডিসি ও ভূমিমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়া যেতে পারে।”
এ ব্যাপারে ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদ বলেন,”জলকদর খাল বাঁশখালী উপকূলের মানুষের জন্য আল্লাহর রহমত। জীবিকার তাগিদে এই খালে মাছ আহরণ করে এই এলাকার লোকজন।অপরদিকে খালটি গলার কাঁটাও। দু’পাশ জবর দখল হওয়ায় পানি সহজে নিষ্কাশন হতে পারে না। ফলে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বন্যার সৃষ্টি হয়। আমি বিষয়টা উপজেলা সমন্বয় সভায় তুলে ধরব।”
এব্যাপারে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তার মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ”জলকদর নামের কোন খালের তথ্য আমার কাছে নেই। দখলের বিষয়টি খতিয়ে দেখে ভূমিদস্যুদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
এদিকে সচেতন মহল বাঁশখালীর ঐতিহ্যবাহী জলকদর খালটি দখলমুক্ত ও খনন করে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও বাঁশখালীর এমপি আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
আনন্দবাজার/শাহী