মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন
চীনের উহান শহর থেকে শরু করে করোনা ভাইরাস পৃথিবীর দেশে দেশে যেভাবে আক্রমণ করে চলছে তাতে সমস্ত স্তরের মানুষ ভয়াবহভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা এখন তিন লাখ ছাড়াল। করোনা ভাইরাসের এখনও কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ বা টিকা নেই। রোগটির প্রকোপে উন্নত বা উন্নয়নশীল, সব ধরণের দেশই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের অনেক দেশে বা এলাকায় লকডাউন চলছে। বাংলাদেশেও ২৬ মার্চ থেকে চলছে অঘোষিত লকডাউন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৪১টি প্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হচ্ছে এই ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মানুষ মরেছে করোনা ভাইরাসে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে সকল দেশে একই দৃশ্য। চিকিৎসা বিজ্ঞান যতটুকু উন্নতি সাধন করেছে পৃথিবীর দুই একটি দেশের উদাহরণ ছাড়া বেশীরভাগ দেশ করোনা ভাইরাসের কাছে রীতিমতো পরাজিত হয়েছে।
লকডাউন চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে, বিশেষ করে সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি, জনগনের ক্রয় ক্ষমতা স্থবির হয়ে পড়েছে। মানুষের দৈনন্দিন আয় কমে গিয়েছে। একজন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অর্থ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। একজন মানুষ শারীরিক বা মানসিকভাবে কতটুকু সুস্থ থাকবে তা নির্ভর করে সে প্রতিদিন তার খাদ্য তালিকায় কি পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করছে তার উপর। বাংলাদেশ পুষ্টি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে গড়ে প্রতিদিন ২২০০ক্যালোরি খাদ্যের প্রয়োজন হয়।ক্যালরির এই ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারায়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে শারীরিক সুস্থতার প্রয়োজনে একজন মানুষকে তার পুষ্টিকর খাবার প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে। পুষ্টিকর খাদ্য তালিকা প্রস্তুতের পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিনিষেধ যথাযথ পালন করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিধিনিষেধ আন্তর্জাতিক মানের এবং সেখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গবেষণা।
বাংলাদেশের চিত্রটা খুবই ভয়াবহ এই কারণে যে, বাংলাদেশ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভয়াবহভাবে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। কিছু উদাহরণ দিলেই বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে। দেশে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশেরই চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। ৮ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৮৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৫৬ জন বাসায় অথবা কর্মস্থলে মারা গেছেন। তাদের ৬৪.৭৪ ভাগই একরকম বিনাচিকিৎসা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আগেই মারা গেছেন। উপসর্গে মৃতদের মধ্যে ১৪.১০ ভাগ স্থানীয় চিকিৎসক, পল্লী চিকিৎসক, হোমিওপ্যাথিক, কবিরাজ এমনকি তান্ত্রিকের কাছে গিয়েছিলেন। ১২.৮২ ভাগ উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান এবং সেখান থেকে চিকিৎসা-পরামর্শ দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তাদের মৃত্যু হয়। ৭.০৫ ভাগ হোম বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে মৃত্যুবরণ করেন। আর ১.২৮ ভাগ একাধিক হাসপাতালে গেছেন, তবে করোনা আতঙ্কে তাদের চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়েছে। ৩.৯০ ভাগ রাস্তার ধারে, মসজিদে, বাজারে, উপকূলে, চা বাগানে, বাসার সামনে বা হাসপাতালের বাইরে মরে পড়ে ছিলেন। (তথ্যসূত্রঃ ০৮.০৫.২০২০ সমকাল)
উপরিউক্ত চিত্র দেখলেই বুঝা যায়, যে কোনো মানুষ এই তথ্যে আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, যারা ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্টমিডিয়ায় বেশী খোঁজখবর রাখেন বা খবর শোনার জন্য টিভিতে বুদ হয়ে থাকেন তাদের মধ্যে মানসিক চাপ সবচেয়ে বেশী। করোনাকালীন সময়ে যারা আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত এবং যাদের নিকটস্থ আত্মীয়স্বজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বা রোগাক্রান্ত অবস্থায় আছেন, তাদের আত্মীয় স্বজনরা সবচেয়ে বেশী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। যারা চিকিৎসার অভাবে হসপিটালের দ্বারে দ্বারে হন্যে হয়ে ঘুরছে তারা মানসিক শক্তি রীতিমতো হারিয়ে ফেলছে এবং হতাশ হচ্ছে। একদিকে মানুষের আর্থিক সংকট, আরেক দিকে সঠিক চিকিৎসার অভাব মানুষকে মানসিকভাবে স্থবির করে দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যে কোনো মানসিক চাপ এবং হতাশা একটা কর্মক্ষম মানুষের ইমিউনিটি সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিতে পারে। তার মানসিক অসুস্থতা শারীরিক অসুস্থতার দিকে ধাবিত করতে পারে। এটা যে কোনো সময়ই বিপদ ডেকে আনতে পারে। শারীরিক সুস্থতার সাথে মানসিক সুস্থতা আন্তঃসম্পর্কিত। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটার সুস্থতা অসম্ভব। মানসিক সুস্থতা আসে একটা মানুষ কতটুকু নিরাপত্তার মধ্যে তার জীবন অতিবাহিত করছে তার উপর।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে প্রায় সব দেশে, অর্থনৈতিক তৎপরতা প্রায় থেমে গেছে। মানুষকে ঘরে থাকতে হচ্ছে। একদিকে ভাইরাস সংক্রমণ, চিকিৎসার অভাব, মৃত্যু, অন্যদিকে অনাহার, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ইত্যাদি সমস্যা সব দেশে এক ধরণের হয়নি। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব দেশে সরকার জনবিপদ শনাক্ত করতে, তার বিরুদ্ধে দ্রুত যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে পেরেছে; সুদৃঢ় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালী করেছে সেসব দেশের নাগরিকদের করোনাকালে জীবন ও জীবিকা দুটি ক্ষেত্রেই সংক্রমণের তুলনায় ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কিউবা, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও জার্মানি। ভারতের ভেতরে রাজ্য হিসেবে কেরালার নাম অবশ্যই চোখে ভেসে উঠবে। এই সবগুলো শর্তেই বাংলাদেশ গুরুতর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যেখানে ব্যর্থতা সেখানেই হতাশা, আর যেখানে হতাশা সেখানে মানসিক অস্থিরতা।
নিরাপত্তাহীনতা থেকেই মানুষ তার মানসিক দৃঢ়তা এবং মানসিক সুস্থতা হারিয়ে বসে। তাতে তার মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। যে মানুষের শরীরে ইমিউনিটি ক্ষমতা কম ভাইরাস তাকে দ্রুত সংক্রমিত করতে পারে। এজন্য একজন মানুষের নিয়মিত ঘুম এবং তিনবেলা খাদ্য তালিকায় দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, শাক সবজি, ফল, এবং আয়রন জাতীয় খাবারের নিশ্চয়তার দিকে খেয়াল রেখে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করাটা জরুরি ব্যাপার। ব্যায়াম একটা মানুষের জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দেয়, শারীরিক এবং মানসিক সতেজতা বৃদ্ধি করে।
“নিরাপত্তা” শব্দটার সাথে অনেক বিষয় ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। জণগনের জীবনের নিরাপত্তা নির্ভর করে একটা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, গবেষণা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণসচেতনতা, জীবন সম্পর্কে মানুষের সচেতন উপলব্ধি, আর্থিক স্বচ্ছলতা, সামাজিক শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা, গণমাধ্যমের ভূমিকা, অনলাইন অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার উপর। একটা দেশের জনগণের জন্য সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তার জন্য উপরোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা এবং জনগণের সচেতনতার অভাব অথবা রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে কোটি কোটি জণগণ বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। তাই প্রয়োজন পরিকল্পিত চিকিৎসা ব্যবস্থা।
কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণে জনগণের জীবন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তার একটা রূপরেখা ঠিক করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে পারলে মানুষকে সমন্বিত একটা নিরাপত্তার আওতাধীন নিয়ে আসা যায়। সমন্বিত নিরাপত্তার জন্য দেশের বিশিষ্টজনদের নিয়ে, বিশেষ করে শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যকর্মী, জনপ্রতিনিধি, সরকারি মন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, সংগঠক, সামাজিক সংগঠন, মানবিক সংগঠনকে সমন্বয় করে দেশের জনগণের নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা যায়। যেটা কিউবা, ভিয়েতনাম, কেরালা সম্ভব করেছে।করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট মোকাবিলা ও ধানচাষীদের রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব।
বর্তমানে ইরি, বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৩ কোটি ২ লক্ষ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন। অথচ সরকার ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ লক্ষ মেট্রিকটন। এই সামান্য পরিমাণ ধান ক্রয় সারাদেশের কৃষককে রক্ষা করা এবং করোনাকালীন সময়ে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। বিশ্বের খাদ্য রপ্তানিকারক দেশগুলো এই করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্যরপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় খাদ্য মজুদের দিকেই নজর দিচ্ছে। কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে চালের পুরো বাজার চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাবে। ইতোমধ্যে হাওরসহ বিভিন্ন এলাকায় যেখানে ধান কাটা শুরু হয়েছে, সেখানে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে প্রতি মণ ৪০০/৪৫০ টাকায় কৃষকেরা ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
তাই সরকারি উদ্যোগে হাটে হাটে, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ধান ক্রয় করা এখন সময়ের দাবী। বাড়তি খাদ্য গুদামজাত ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এবং বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি খাদ্য গুদামের পাশাপাশি বেসরকারি গুদাম ভাড়া করা, কৃষকদের কাছে ধান রেখে টাকা পরিশোধ করার ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে যাতে শাঁখের করাতের মতো কৃষক এবং জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রত্যেক ইউনিয়নে খাদ্যগুদাম এবং সবজি উৎপাদনের অঞ্চলে সবজি সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগে কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করতে হবে। আমন মৌসুমে বন্যায় বীজতলা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে দিয়ে পর্যাপ্ত বীজতলা তৈরির করার ব্যবস্থা করতে হবে।বিএডিসির মাধ্যমে উৎপাদন খরচে কৃষকদের মাঝে সার, বীজ এবং কীটনাশক সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান লকডাউনের আওতাধীন রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিল্প কলকারখানা পর্যন্ত সমস্ত দোকান পাটের সাটার বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে ভোগ্য পণ্য, ভারী শিল্প উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত করণ, পৃথকীকরণ, মোড়কীকরণ,
গুদামজাতকরণ, পরিবহন, লোড আনলোড, আমদানি রপ্তানি, ব্যবসা বাণিজ্য, পাইকারি ব্যবসা, খুচরা ব্যবসা অর্থাৎ উৎপাদন এবং বিতরণ বণ্টন সমস্ত সেক্টর বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন, বিতরণ কার্যক্রমের সাথে নিযুক্ত হাজার হাজার শ্রমিক, কর্মচারী, বেকারত্বের মধ্যেই জীবন অতিবাহিত করছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ভয়াবহ বিপদে পড়েছে। তাদের বকেয়া বেতনের দাবীতে এখনও রাস্তায় নামতে হচ্ছে।
লকডাউন দীর্ঘমেয়াদী হওয়াতে আর্থিক সংকটে পড়েছে সকল শ্রেণী পেশার ফরমাল ইনফরমাল শ্রমিক। এর পাশাপাশি কল কারখানা, ব্যাংক, বীমা, ক্ষুদ্র, মাঝারী বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লোকসানে জর্জরিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে লকডাউন চলে যাওয়ার পরেও হাজার হাজার শ্রমিক চাকুরীচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন পুঁজি। দীর্ঘ লকডাউনে সকল মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই দেউলিয়া হয়ে পড়েছে । লোকসান নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে পুনরুৎপাদন করা সম্ভব নয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিক, কর্মচারীদের চাকুরীর নিশ্চয়তা খুবই ক্ষীণ। তবে এখানে সমাধান রয়েছে। তা হল সরকারি উদ্যোগে দেশের সকল ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং সরকারি নিজস্ব উদ্যোগে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা। সরকারি অর্থ যাতে কোনোরূপ জালিয়াতির সম্মুখীন না হয়, ঋণখেলাপীদের খপ্পরে না পড়ে তার নিশ্চয়তা নিয়ে সরকার অর্থ সহায়তা দিতে পারে। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোতে বৃহৎ মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর অলস পুঁজি জমে রয়েছে যা সরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্য সেবা,চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ, কৃষি ঋন, শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তা নাহলে শ্রমিক কর্মচারীদের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে হাজার গুণ ।
করোনা ভাইরাস চলে যাওয়ার পর একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের প্রথমত চাকরির অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে যা আমি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি,দ্বিতীয়ত গার্মেন্টস শ্রমিকরা আর্থিক সংকটে পড়বে,গার্মেন্টস শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে,গার্মেন্টস শ্রমিকদের জমানো সকল পুঁজি যখন নিঃশেষ হয়ে যাবে তখন নিম্নবৃত্ত থেকে সরাসরি একটা অংশ সর্বহারা হয়ে যাবে,পথে বসে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে পারিবারিক কলহ-বিবাহ বিচ্ছেদ, নারীনির্যাতন, শিশুহত্যা, আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি, ছিনতাই এবং অন্যান্য সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। যার প্রভাব পড়বে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। এই সমস্ত সমস্যা ঠেকানো যায় যদি রাষ্ট্র মূলত তিনটি ভূমিকা সরাসরি নিতে পারে। ১. রাষ্ট্রীয় সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ কিংবা বাংলাদেশে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে তা সুনির্দিষ্টকরণ। ২. সমস্যা সংকট বা মহামারিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা জরুরি বিষয় হিসেবে দেখার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে, এমনকি কেউ কোনো সমস্যা ধরিয়ে দিলে তার জন্য সরকারি সহায়তা বৃদ্ধিকরণ এবং ৩. সরকারের সব পর্যায়ে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যগত প্রস্তুতি গ্রহণ, এবং সকল স্বাধীন প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকাকে রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণ বা উদ্যোগ গ্রহণ যদি যথাসময়ে করা যায় তাহলে চিকিৎসা এবং খাদ্য যোগান উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা সংকট সমাধান করা যায়।
করোনা পরীক্ষার সামগ্রী সংগ্রহ, বুথ স্থাপন, দায়িত্ব বণ্টন, হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা, আইসিইউ-ভেন্টিলেটর প্রস্তুত রাখা, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রী প্রস্তুত রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারলে যে কোনো বিপর্যয়কেই মোকাবিলা করা যায়।সমাজের বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা-মতবিনিময়-পরামর্শ করে সমন্বিত সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায়। কিন্তু আমরা দেখেছি সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যেই সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়েছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জন্য বেঁচে থাকার সামগ্রী যোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা পুরোপুরিভাবে করা যায়নি। লকডাউনকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হলে নূন্যতম একমাসের খাদ্যসামগ্রী নিম্ন আয়ের মানুুষদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে সরকারী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা মাসিক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এখনও সময় রয়েছে উপরিউক্ত সমস্যা সংকট চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
করোনা ভাইরাসকে চোখে দেখা যায় না। তবে করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের পর তার উপসর্গগুলো সবারই চোখে পড়ে। জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয় উপসর্গ, পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচ দিন সময় নেয়। এমনকি অনেক সময় উপসর্গ ছাড়াই ব্যক্তি করোনা আক্রমণের শিকার হতে পারে। তাই প্রতিটি মানুষকে প্রথমে করোনা সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে, এবং রোগ থেকে মুক্তির উপায়গুলো ভালো করে জেনে তার দিক নির্দেশনাগুলো যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করতে হবে। ৫৬ হাজার আক্রান্ত রোগীর উপর চালানো এক জরিপ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে: এই রোগে ৬% কঠিনভাবে অসুস্থ হয় – তাদের ফুসফুস বিকল হয়, সেপটিক শক, অঙ্গ বৈকল্য এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হয়। ১৪% এর মধ্যে তীব্রভাবে উপসর্গ দেখা যায়। তাদের মূলত শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি হয়। ৮০% এর মধ্যে হালকা উপসর্গ দেখা যায় – জ্বর এবং কাশি ছাড়াও কারো কারো নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের কোনো ধরণের অসুস্থতা রয়েছে (অ্যাজমা, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ) তাদের মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ভ্যাকসিন, বা যে কয়েকটি টিকা এখন পর্যন্ত গবেষণার পর্যায়ে আছে – তাতে আদৌ কোনো কাজ হবে কিনা তা জানতে ছয় মাস বা তার বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
সারা পৃথিবীজুড়েই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন গবেষণার কাজ দ্রুততর করতে। এই রোগ থেকে এখন পর্যন্ত রক্ষার একমাত্র উপায় হলো, অন্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেয়া। যার মানে হলো: ১.মানুষজনের চলাচল সীমিত করে দেয়া। ২.হাত ধুতে সবাইকে উৎসাহিত করা। ৩.স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে রোগীদের আলাদা আলাদা চিকিৎসা সেবা দেয়া। ৪. পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। আমরা যে কেউ যে কোনো সময় এই সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারি। তখন আমাদের করণীয় হচ্ছে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন না হয়ে দেশের যে যে হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা সুনিশ্চিতভাবে পাওয়া যায় সেখানে খবরটি জানানো,এবং যথাসম্ভব চিকিৎসার আওতাধীন নিজেকে নিয়ে আসা, পাশাপাশি নিজের মনোবল বৃদ্ধি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করা যাতে দ্রুত ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সর্বোপরি সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ব্যক্তি সচেতনতার যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমেই কেবল করোনা সংকটকে মোকাবিলা করা সম্ভব।
লেখকঃ মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন লেখক ও কলামিস্ট
আনন্দবাজার/শাহী