ঢাকা | শুক্রবার
২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চট্টগ্রামের একমাত্র নারী রিক্সচালক ফাতেমা

বেলা ১২ টার কাটা ছূঁই ছূঁই। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারের কেয়ারী শপিংমলের সামনে মাথায় হেলমেট পরা রিক্সায় বসে হেন্ডেল পা রেখে উচ্চ শব্দে ৪৫-৫০ বয়সি এক মহিলা ‘আসবার কালে আসলাম একা..যাবার কালে যাবো একা..মাঝে মাঝে মনোরে বলি..চক্ষু মেলে কি দেখলা’ গানটি বাজিয়ে রিক্সা চালাচ্ছিলেন। নাম তার জেসমিন আকতার ফাতেমা।

আজকাল সমাজের সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সমানভাবে থাকলেও রিক্সা চালানোর কাজে সাধারণত নারীদের দেখা যায় না। তবে জীবন যুদ্ধে হার না মেনে জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন চট্টগ্রামের একমাত্র মহিলা রিক্সাচালাক জেসমিন আক্তার ফাতেমা। ফাতেমা বেঁচে থাকার সংগ্রামে পুরুষদের পাশাপাশি রিক্সা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বন্দরনগরী বিভিন্ন এলাকায়। রোজগারের টাকায় ৩ সন্তানকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি ৫ জনের সংসারও সামলাচ্ছেন তিনি।

দেশে রিক্সা বেশ জনপ্রিয় পরিবহন হলেও চালানোটা খুবই কষ্টসাধ্য। তবে এ অসাধ্য সাধন করেছেন ফাতেমা। নগরীর ওয়াসা, জিইসি, লাভলেইন মোড়, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে কিংবা হেলমেট পরে রিক্সা চালাতে দেখা যায় ফাতেমাকে। বলতে গেলে ফাতেমা একজন যথেষ্ট সচেতন চালাক। কারণ সে নিজের সুরক্ষায় হেলমেট ব্যবহার করেন। সত্যি এটাও সেই সব মোটর বাইক চালকদের কাছে একটি শিক্ষানীয় বিষয়। যারা নিজেদের সুরক্ষায় কখনো ভাবেন না। তবে রিক্সা চালানোর সময় ফাতেমা উচ্চশব্দে গান বাজিয়ে যাত্রীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন।

জানা যায়, ৪৫-৫০ বছর বয়সী ফাতেমার বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর থানার ইলিয়তগঞ্জ ইউনিয়নের বাপোটি গ্রামে। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় এক রিক্সাচালকের সঙ্গেই। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্বামীকে প্রবাসে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এসে আরেকটা বিয়ে করে চলে গেছে। এতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

ফাতেমা ৩ সন্তানের জননী। চট্টগ্রাম নগরীর ওয়ারলেস এলাকায় ৮০ উর্ধ্ব মা মোমিনা খাতুনকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। তার ৩ সন্তান তাজুল ইসলাম, হাসান ও হোসাইন থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে একটা ছোট ভাইও থাকেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে ফাতেমা তৃতীয়।

বিগত ১৫ বছর ধরে রিক্সা চালাচ্ছেন ফাতেমা। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রিক্সা চালাতে হয় বের হতে হয় ফাতেমাকে। দুপুরে বাসায় গিয়ে খাবার খেয়ে আবার ৩টার দিকে বের হন, রিক্সা চালান রাত ৮টা পর্যন্ত। এতে দৈনিক ৫’শ থেকে ১২’শ টাকা পর্যন্ত আয় করেন ফাতেমা। এর মধ্যে রিক্সাভাড়া জমা দেন ৩’শ টাকা।

রিক্সা কীভাবে চালানো শিখেছেন জানতে চাইলে ফাতেমা বলেন, ‘নিজে নিজে চালানো শিখসি। চট্টগ্রামে প্রথমে আসার পর বিআরটিসি গাড়ি ক্লিনিং করতাম। বাসা বাড়ির কাজ থেকে গার্মেন্টের কাজ সবই করসি।শুধু নিজের কথা ভাবলে পরের বাড়িতে দাসী হতে সমস্যা ছিল না৷ কিন্তু সন্তান থাকলে সেটা সম্ভব নয়৷ আর ফ্যাক্টরির কাজ অনেক কঠিন এবং পয়সা অনেক কম৷ সবকিছু বিবেচনা করে শেষমেশ রিকশা চালানোকেই পেশা হিসেবে নেন চট্টগ্রামের এই সাহসী নারী৷ তবে শুরুটা সহজ ছিল না৷ সমাজ থেকে বাধা এসেছিল৷ নারী বলে কেউ তার রিক্সায় উঠতে চাইতোনা৷ অনেকে মনে করতেন, মেয়েরা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা ইসলামে বারণ আছে। আবার নারী বলে তাঁকে ভাড়া কম দিতে চাইতো।

এদিকে রিক্সা চালাতে গিয়ে এ নারীকে প্রতিনিয়তই সহ্য করতে হয় নানা কটুকথা। তবে অনেকেই তাঁর সাহসী কাজের প্রশংসা করেন। মা রিক্সাচালক হওয়ায় সন্তানরা যাতে অসম্মানিত বোধ না করেন সেজন্য নিজের কাছ থেকে দূরে গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছেন প্রিয় সন্তানদের।

ক’দিন ধরে রিকশা চালাচ্ছেন জানতে চাইলে ফাতেমা বলেন, ‘অনেকদিন, প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরেই রিকশা চালাচ্ছি।’ রিক্সা চালাতে কোনো সমস্যা হয় না? জবাবে তিনি বলেন, ‘সমস্যা অইবো ক্যান পুরুষ পারলে আমরা ক্যান পারবো না? জীবনে কষ্ট করেছি বহুত। তয় প্রথমে কিছু লোকে এ পেশাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। অনেকেই হাসি-ঠাট্টা ও সমালোচনা করতো। আবার কিছু লোক সহযোগিতাও করেছে।’

এই রিক্সা চালিয়ে বড় পোলারে আই এ (ইন্টারমিডিয়েট), মেঝডা মেট্রিক (এসএসসি) দিছে, আর ছোটডা ক্লাস টেনে পড়ে। ওরা কুমিল্লায় মামার বাড়িতে থাকে । আমি এই হান থেইক্যা খরচা পাঠাই দি।’

এত কিছু থাকতে রিকশা চালানো পেশা কেন? সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরটা দিলেন ফাতেমা, ‘বাসায় কাম লইছি, ২ হাজারও দেয় না বাবা, ১৫শ দেয়, পোষায় না। নানা খরচা আছে, ঘর ভাড়া, খানার খরচ, পোলা পাইনের লেখা-পড়ার খরচ, তাদপর পোশাক আছে। গার্মেন্টসে চাকরি করতাছি, তখন ৩ হাজার টাকা দিছিল। এই আয়েও পোষায় না দেইখ্যা এই রিকশা ধরলাম। আগে তো ব্যাটারীচালিত রিক্সা আছিল না, পায়ে চালাইতাম। বেশি কষ্টের কাম।’ আবার মাঝে মাঝে পুলিশে ধরতো। তয় এহন আর পুলিশরাও ধরে না আমারে। সাইড দিয়া দেয়।’

ট্রাফিক পুলিশ আমজাদ হোসেন বলেন, রাস্তায় নিয়মকানুন মেনেই রিকশা চালান জেসমিন৷ এমনকি হেলমেটও পরেন, যা অন্য রিকশাওয়ালারা সচরাচর পরেন না৷

জীবন যুদ্ধে হার না মানা এ নারীর মতে, দেশের সব নারীকে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। লোকে কী বললো তার দিকে না তাকিয়ে কাজ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তার কর্মজীবনেও প্রথম প্রথম কাজ করতে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। ভাবতেন লোকজন কে কী বলবে। এখন তার কাছে সেটা আর কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় না।

আনন্দবাজার/এম.কে

সংবাদটি শেয়ার করুন