ইফতেখারুল ইসলাম ইফতি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে। তিনি তার জীবনকে শুধু পড়াশোনার গন্ডিতেই বেধে রাখেননি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আবৃত্তিকার ও গায়ক হিসেবে রয়েছে বেশ সুনাম। তাছাড়া বন্ধুমহলে ইফতি একজন বিনয়ী, মেধাবী ছাত্র ও লেখক হিসেবে সুপরিচিত। প্রাইমারি স্কুল জীবন থেকে যখনই সময় পেয়েছেন সমাজসেবায় নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। বলতে গেলে পরিবার থেকেই এই সমাজসেবার হাতেখড়ি। তার জীবনের এরকম নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে দৈনিক আনন্দবাজারের প্রতিবেদক শাহীদুল ইসলাম আপনের সাথে।
পুরনো বছর কেমন কাটলো এমন প্রশ্নে তিনি হেসে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ্ অনেক ভাল কেটেছে। সত্যি বলতে প্রতিটি বছরই আমার নিজস্ব কিছু লক্ষ্য থাকে। সে লক্ষ্য অনুযায়ীই আমি কাজ করে যাই। ব্যস্ততাকেই নিজের সঙ্গী হিসেবে তৈরী করে নিয়েছি, যে কারণে কাজকে কখনো জঞ্জাল মনে হয়না। বরং কাজ না থাকলে অনেকটাই ফাঁকা মনে হয় নিজেকে। তবে শত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারকে সময় দিতে চেষ্টা করি। সবমিলিয়ে খারাপ যায়নি বিগত বছর।
ছোটবেলা থেকেই কি পুলিশ হতে চেয়েছিলেন? এই বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ হবো এমন ইচ্ছা কখনো ছিল না। আমার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন এবং মা ছিলেন গৃহিণী। তাছাড়া আমার পরিবারের অনেক সদস্য বিভিন্ন দেশের স্থায়ী নাগরিক। হয়তবা আমারও এরকম কিছু হওয়ার কথা ছিল। যদিও আমি পরিসংখ্যানের ছাত্র ছিলাম , কিন্তু মনের মাঝে সবসময় একটা সুপ্ত বাসনা ছিল আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করার। আর সেই লক্ষ্য পূরণের জন্যই প্রেস ইনস্টিউট অব বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিকতার উপর পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশন করেছি। সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে একটি বেসরকারী টেলিভিশনেও অল্প কিছুদিন কাজের সুযোগ হয়েছে। তারপর ভাগ্য পরিক্রমায় এই পেশায় চলে এলাম। অবশ্য এই পেশায় আসার পেছনে রয়েছে ছোট্ট একটি গল্পও।
পরিবার থেকে হুট করেই চাপ আসছিল ভাল একটা কিছু করার জন্য এবং তারাই পরামর্শ দিলেন বিসিএসের দিকে অগ্রসর হওয়ার। কিন্তু মজার বিষয় হলো বিসিএস সম্পর্কে মোটাদাগে ধারণা থাকলেও এ বিষয়ে আদ্যোপান্ত জানা ছিল না। ভাইবোনদের কথামতো স্বল্প প্রস্তুতি নিয়ে ৩০ তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করি। সেবারই প্রিলি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভাইভা’তে যেয়ে বাদ পড়ে যাই। এরপর নিজের সাথেই অনেকটা পন করে বিসিএসের জন্য আরো ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করলাম। আল্লাহর রহমতে ৩১ তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হই। আর এই হচ্ছে আমার পুলিশ হওয়ার পেছনের গল্প।
পেশাগত জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, আজকের এই পর্যন্ত আসার পথটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। সত্য থেকে কখনো পিছপা হইনি, নিজের দৃঢ়তা ও সংকল্পই এই কঠিন বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে সহায়তা করেছে। সিনিয়র স্যার ও সহকর্মীদের অকুন্ঠ সহযোগিতা আমার চলার পথকে মসৃণ করে দেয়। তাঁদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। তাছাড়া যার কথা না বললেই নয়, আমার স্ত্রী আমার অনুপ্রেরণার অন্যতম একজন। জীবনের কঠিন সময়েও সে আমাকে সাহসিকতা জুগিয়েছে। ছায়ার মতো পাশে রয়েছে। সংসার নিয়ে আমার খুব বেশি একটা মাথা ঘামাতে হয় না। কারণ পুরোটা বিষয় ও একাই সামলে নেয়। বাচ্চা-সংসার সামলানো মুখের কথা নয়। আসলে পেশাগত জীবনের সাথে পারিবারিক জীবনটা টেনে নিয়ে আসার মূল কারণ হচ্ছে পুলিশ পেশায় পরিবারের সমর্থন অতীব জরুরি। কারণ পুলিশের পরিবারকে প্রতিনিয়ত আত্মত্যাগ করতে হয়। নিজ পরিবারের সমর্থনটুকু আমি সবসময় পেয়েছি।
অর্জন হিসেবে বলতে গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল’ গ্রহণ করা আমার জীবনের অন্যতম একটি পাওয়া। এছাড়া আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে থাকাকালীন আট বার শ্রেষ্ঠ ‘সহকারী কমিশনার’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে পেয়েছি আন্তর্জাতিক সম্মাননা, যা আমার কাজের অগ্রগতিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
পেশাগত জীবনের আক্ষেপের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আক্ষেপ বলতে তেমন কিছু নেই। তবে যেটুকু আক্ষেপ তা হচ্ছে আপনারা জানেন একজন পুলিশের ১২-১৬ ঘন্টা ডিউটি থাকে। এমন অনেক রাতই গিয়েছে বাসায় গিয়ে দেখেছি আমার মেয়ে আমার জন্য কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন নিজের কাছে খুব খারাপ লাগতো। বাবা হিসেবে হয়তো সেরকমভাবে মেয়েকে সময় দিতে পারছি না। মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের অনেক দাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারি না। এতে অনেকেই কষ্ট পায়। বাকীসব ঠিক আছে।
সমাজসেবার কথা তুলতেই তিনি বলেন, পুলিশের পেশাইতো একটা সমাজসেবা। এর বাহিরেও যখনই সুযোগ পাই সামাজিকভাবে অবহেলিত, জীবনযুদ্ধে হার মেনে নেওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘প্রোজেক্ট ফর হিউম্যানিটি’ নামে একটি সংগঠন আগে থেকেই আমাদের রয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতিবছরই সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের মানুষদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হয়ে থাকে। বাইরে থেকে কোনো ধরণের সাহায্য ছাড়াই পরিচালিত হয় এই সংগঠনটি। সম্প্রতি অ্যামাজনে আগুন লাগার পর দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে গড়ে তুলেছি ‘আমার সবুজ বাংলা’ নামে একটি সংগঠন। যে সংগঠনের প্রধান কাজই হচ্ছে প্রতি মাসে একশো করে বৃক্ষরোপন করা।
নিজের পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে কখনো মাথানত করিনি। নিজের দায়িত্বটাকে সবসময় প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। দেশ ও মানুষের সেবক হিসেবেই নিজেকে ভাবতে ভালো লাগে। আমি মনে করি সবার আগে আমার দেশ তারপর অন্যকিছু।
নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিকল্পনা বলতে নিজের যা দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করাই থাকবে আমার প্রধান লক্ষ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জন্য নিরলসভাবে দিনরাত যে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন , তা বাস্তবায়নে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে দেশ ও মানুষের কল্যানে আইনশৃঙ্খলা বিভাগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ভাবমূর্তি উন্নয়নেই দৃঢ়ভাবে কাজ করে যেতে চাই।
পুলিশ হিসেবে যারা নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমার মনে হয় যারা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দকরে তাদের এই পেশায় আসা উচিৎ। কারণ এই পেশা খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং আত্বত্যাগের। এর মাধ্যমে সরাসরি মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটির পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এই পেশায়। তবে একইসাথে পর্যাপ্ত সমালোচনা শোনার মানসিকতাও থাকতে হবে।
পেশাগত জীবন শেষে কি করতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন অনেক মানুষ আছে যারা বৃদ্ধ বাবা মাকে বাসা থেকে বের করে দেন, কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না। তাদের জন্য আমি একটি বৃদ্ধাশ্রম তৈরী করতে চাই। যেখানে প্রতিটা বাবা-মা’ই একটু আরামে বাকি জীবন কাটাতে পারবেন। পাশাপাশি অনাথ শিশুদের জন্য একটি এতিমখানা করতে চাই, যাতে প্রতিটা শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। আর এই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখন থেকেই নিজেকে গোছানো শুরু করেছি।
সবশেষ তার প্রিয় অঙ্গন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, শুধু গৎবাঁধা লেখাপড়াই জীবন নয়। জীবনটাকে জানতে হবে, উপভোগ করতে হবে। তবে হ্যাঁ, এমন কিছু করা যাবে না যা নিজের, পরিবার ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। লক্ষ্যটাকে ঠিক রেখে অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও আত্মসামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। এছাড়া নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকা, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে নিজেকে অন্যদের চেয়ে বেশী সমৃদ্ধশীল করে তোলা যাবে।
আনন্দবাজার/শাহী