প্যাডেলচালিত রিকশায় পরিশ্রম বেশি কিন্তু সেই তুলনায় আয় কম, আর ব্যাটারিচালিত অটো রিকশায় পরিশ্রম কম হলেও আয় বেশি হয় চালকের। সে কারণে প্যাডেলচালিত রিকশা ছেড়ে অটোর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন চালকরা । এতে চরম বিপাকে পড়েছেন প্যাডেলচালিত রিকশার মালিকরা। চালকের অভাবে গ্যারেজে রিকশা পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই ভাঙারির দোকানে কেজি দরে রিকাশা বিক্রি করে দিচ্ছেন মালিকরা।
মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার রিকশা গ্যারেজের মালিক বাবু বিশ্বাস জানান, ৪৫ বছর আগে তার বাবা ইস্কান্দার বিশ্বাসের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল এই গ্যারেজ। সেসময় সারা ঢাকায় ‘ এটি বিশ্বাসের গ্যারেজ’ নামে একনামে পরিচিত ছিল। এখনও তাদের সেই পরিচিতি থাকলেও ব্যবসা আর আগের মতো নেই।
তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্যারেজে একসময় দেড় শতাধিক রিকশা ছিল। এত রিকশা থাকার পরও চালকদের টানাটানি পড়ে যেত। একজন চালক রিকশা জমা দেওয়ার আগেই আরেকজন সেটি চালানোর জন্য গ্যারেজে অপেক্ষা করতো। আর এখন গ্যারেজে রিকশায় আছে মাত্র ৫০টি। কিন্তু সেগুলোও গ্যারেজে পড়ে আছে, চালকের দেখা পাচ্ছি না।’
তিনি জানান, প্যাডেলচালিত একটি রিকশার জন্য সারা দিনে একজন চালককে ১২০ টাকা দিতে হয় মালিককে। আর আধা বেলার (সকাল ৫টা থেকে দুপুর ২টা কিংবা দুপুর ২টা থেকে রাত ১২ টা) জন্য মালিক পান ৭০ টাকা।
গ্যারেজে পড়ে থাকা রিকশাগুলো দেখিয়ে বাবু বিশ্বাস বলেন, ‘বছর খানেক আগেও চালকের অভাব ছিল না। পরিচিত-অপরিচিত চালকরা সকাল দুপুর গ্যারেজে ধর্ণা দিত রিকশার জন্য। সেই সময় দুপুরে গ্যারেজে চালক থাকতো, রিকশা নয়। আর এখন দেখেন সবগুলো রিকশা পড়ে পড়ে আছে। আজ মাত্র ৮টা রিকশার চালক পাইছি। অনেক রিকশা গ্যারেজে বসে থাকতেই থাকতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘চালক পাইবেন কিভাবে? কে আর চায় পরিশ্রম বেশি করতে? আরামের জন্য সবাই অটো চালাইতেছে। তাদেরতো আর দোষ দিতে পারি না। কিন্তু আমাদের ব্যবসাতো শেষ। গত ১৫ দিনে গ্যারেজের মিস্ত্রি আর সিউরিটিটির বেতন দিয়ে ১ হাজার টাকাও ঘরে নিয়ে যাইতে পারি নাই। এভাবে হলে সংসার চালামু কিভাবে?’
বাবু বিশ্বাস বলেন, ‘ গ্যারেজে পড়ে থেকে রিকশাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই সেগুলো ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে দিচ্ছি। একটা নতুন রিকশা বানাতে যেখানে ২৫ হাজারের বেশি টাকা লেগেছে, এখন সেই রিকশা ভাঙারির দোকানে বিক্রি করছি ১২০০-১৫০০ টাকায়।’
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দাপটে চালকের অভাবে নিজের গ্যারেজ বন্ধই করে দিয়েছেন মোহাম্মদপুরের আদাবরের মো. আলাউদ্দীন। তিনি বলেন, একেকটা রিকশা বানাইতে আমার খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকার মতো। কিন্তু সেই রিকশা আমি কেজি দরে বেচছি ভাঙারির দোকানে।
তিনি জানান, আগে পুরাতন রিকশাও বিক্রি হতো ১০ হাজার টাকার বেশি দামে। কিন্তু এখন ব্যবসা আর নেই বলে কেউ পুরাতন রিকশা কিনতে চায় না। ভাঙারির দোকানে সেসব রিকশার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকায়।
আলাউদ্দীন বলেন, ‘আমার গ্যারেজের ২০টা রিকশা বেইচাও একটা অটোরিকশার দাম পাই নাই। ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় সংসার চালাতে প্যাডেল রিকশা বেচার টাকা দিয়ে ফুটপাতে কাপড়ের দোকান দিছি।’
অন্যদিকে ঢাকা শহরের রাস্তায় একসময় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে কয়েক লাখ প্যাডেলচালিত রিকশা চললেও এখন সেই সংখ্যা ৫০ হাজারের আশপাশে নেমে এসেছে বলে দাবি করেছেন রিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রিকশা মালিক ঐক্য জোটের সহসাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান মজিদ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমিতির হিসেব মতে ঢাকায় এখনও ৩ লাখ প্যাডেলচালিত রিকশা আছে। কিন্তু রাস্তায় চলে ৫০ হাজারের মতো। চালকের অভাবে বাকি সব রিকশা গ্যারেজে বসা। আমার গ্যারেজেই ১০০ রিকশা আছে, কিন্তু সড়কে বাইর হয় মাত্র ২০-২৫টা। ’
মো. মজিবুর রহমান মজিদ জানান, গত ৩০ বছর ধরে রিকশার গ্যারেজের ব্যবসা করেন তিনি। আদাবরে ৯ কাঠা জায়গায় থাকা রিকশার গ্যারেজের জন্য প্রতিমাসে তাকে ৭০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এছাড়াও গ্যারেজে মিস্ত্রি ও নিরাপত্তারক্ষীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, পানি বিল, ও গ্যাসবিল মিলিয়ে আরও ৬০ হাজার টাকার বেশি খরচ।
তিনি বলেন, ‘সবমিলিয়ে গ্যারেজে প্রতিমাসে লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। এখন ব্যবসা করে সেই খরচের টাকাও উঠে না। ঋণ করে কোনো করে নিজের পুরাতন ব্যবসাটা টিকিয়ে রেখেছি। কিন্তু এভাবে আর ব্যবসা বেশিদিন টেকানো সম্ভব নয়।’