ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্মার্ট আইডি কার্ড ছাপাবে ভারতের কোম্পানি!

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) স্মার্ট কার্ড ছাপানোর কাজ দেওয়া নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। কেবল এনআইডি ছাপানোর কাজ দিয়ে দেশের প্রায় তিন কোটি নাগরিকের তথ্য ভারতে পাচারের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর নাগরিকের নিরাপত্তাজনিত শঙ্কার পাশাপাশি, এই কাজে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ নিয়ে লোপাটের পাঁয়তারার চেষ্টা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাপানো খরচ কার্ড প্রতি প্রায় ৮০-৯০ টাকা বেশি খরচ দেখিয়ে কমপক্ষে আড়াইশ’ কোটি লোপাট করার পাঁয়তারা চলছে। হাসিনা সরকারের বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে তথ্য পাচার, ডলার সংকট চলাকালে লাখ লাখ ডলার দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার এই বন্দোবস্ত ঠেকানোর কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যদিও হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে কয়েক মাস পার করে দিয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এনআইডি বা স্মার্ট কার্ড ছাপানোর মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। কিন্তু ইসি নিজে না ছাপিয়ে ডিরেক্ট পার্চেজ মেথডে এই কাজ দেয় সামরিক বাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে (বিএমটিএফ)। ইসি নিজে কেন ছাপানোর এই দায়িত্ব নিলো না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে, চুক্তি অনুযায়ী বিএমটিএফ কার্ড ছাপিয়ে তা নির্বাচন কমিশনকে হস্তান্তর করবে। বিএমটিএফ নিজেরা এই কাজ সুষ্ঠুভাবে করতো তবে তা নিয়ে খুব সমস্যার কিছু ছিল না। কিন্তু তারা এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে।

অন্যদিকে, বিএমটিএফের প্রতি স্মার্ট কার্ড ছাপানোর দর হলো প্রায় ১৭০ টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৭০ টাকার এই দরে না দিয়ে ২৫০-২৬০ টাকারও বেশি দরে একটি বিদেশি কোম্পানিকে প্রায় তিন কোটিরও বেশি কার্ড ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ১৭০ টাকা দরে তিন কোটি কার্ডের সম্ভাব্য খরচ ৫১০ কোটি টাকা। ২৬০ টাকা দরে এই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই দেশের বাড়তি ২৭০ কোটি টাকা খরচ বাড়ানো হচ্ছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় তাদেরকে ডলারে পরিশোধ করতে হবে। এতে ৭৮০ কোটি টাকার সমমানের ডলারও চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

সমস্যা এখানেই শেষ নয়। বলা যায়, শুরু। বিদেশের কোন প্রতিষ্ঠানকে বেশি টাকায় কাজটি দেওয়া হচ্ছে, সেই অনুসন্ধানে নেমে সামনে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি হলো ফ্রান্সভিত্তিক ‘সেল্প’। সেল্পের ওয়েবসাইটে (https://www.selp.fr/en/selp-group-en/) স্ক্রল করে নিচের দিকে গিয়ে দেখা যায়, দিল্লিতেও প্রতিষ্ঠানটির অফিস আছে। দিল্লির অফিসের ঠিকানা লেখা—SELP India Pvt Ltd, Registered Office, A272 LGF, Defence Colony, Delhi 110024, India. অর্থাৎ দিল্লির সামরিক কলোনিতে এর অফিস অবস্থিত। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের স্মার্ট কার্ড ছাপানো হবে কোথায়? মুম্বাইয়ে সেল্পের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট (উৎপাদন কারখানা) রয়েছে। ঠিকানা: SELP India Pvt Ltd, Manufacturing Site, Falcon House, A-194, TTC Industrial Area, MIDC Khairane, New Mumbai – 400709, Maharashtra, India.

ওয়েবসাইটে থাকা সেল্পের ঠিকানা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে, দেশের তিন কোটি নাগরিকের স্মার্ট কার্ডের চিপে থাকা সব তথ্য আসলে ফ্রান্সের নামে কোন দেশে যাচ্ছে? এর উত্তর অবশ্য মেলে ফ্রান্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটেই লেখা থেকে। সেখানে লেখা—‘With a factory in Mumbai and a sales office in New Delhi, SELP India is an independent subsidiary that provides secure cards…’। অর্থাৎ স্বাধীন সাবসিডিয়ারি হিসেবে ভারতে অবস্থিত সেল্পের অফিস কাজ করবে।

একে তো বেশি দামে আড়াইশ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হচ্ছে, আবার এমন এক কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে যার মাধ্যমে ভারতের হাতে পাচার হচ্ছে তথ্য। প্রথম কিস্তিতে ছাপা হবে তিন কোটি। যদি এই কিস্তির কাজ সম্পূর্ণ সফল হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানটি আরও কাজ পাবে। মোদ্দকথা, ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সব নাগরিকের তথ্যের মালিকানা চলে যাবে তাদের হাতে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এ ধরনের কাজের সক্ষমতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানও আছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, দেশ কার্ড ছাপানো সক্ষম প্রতিষ্ঠান থাকতে ফ্রান্স আর ভারতের ওই প্রতিষ্ঠানকেই কেন কাজ দিতে হবে? শুধু তাই নয়, প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাতের সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুইয়ের (Marie Masdupuy) সুসম্পর্কই এই কাজ দেওয়ার নেপথ্য কারণ?

হাসিনা সরকারের পতনের পরও ফরাসি প্রতিষ্ঠানটিকে স্মার্ট কার্ড ছাপানোর কাজ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তে অটল বিএমটিএফ। সচেতন নাগরিকদের কেউ কেউ মনে করছেন, আগের সরকারের ধারাবাহিকতায়ই চলছে এসব দুর্নীতি এবং নাগরিকদের তথ্য পাচারের পাঁয়তারা।

জানা গেছে, স্মার্ট কার্ড ছাপানোর এই কাজে ইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সায়েম। আর বিএমটিএফের পক্ষে এই কাজের দায়িত্বে আছেন ডিরেক্টর মার্কেটিং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ। আর বিএমটিএফের সার্বিক দায়িত্বে আছেন মেজর জেনারেল নাহিদ আসগর।

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার ইসি সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনও বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কার্ড ছাপানোর কাজ দেওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলতে গত তিন মাস ধরে বিএমটিএফের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা এই ব্যাপারে কথা বলায় অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

এছাড়া ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও এই ব্যাপারে কথা বলায় অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

খবর বাংলা আউটলুক

আনন্দবাজার/ এমকে

সংবাদটি শেয়ার করুন