৫ আগস্ট সোমবার ছাত্র-জনতার ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণার দিন পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করবে– এমনটাই আগের দিন জানিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। আগের দিন রোববার রাতে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আর এক বিন্দু ছাড়ও দেয়া হবে না। পুলিশ হত্যাকারীদের কোন ছাড় দেয়া হবে না।’ এমন ঘোষণার পর সোমবার সকাল থেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয় ঢাকার সব প্রবেশমুখে।
ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদসহ সব ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা সেদিন সকালেই চলে যান রাজধানীর সচিবালয়ের বিপরীতের আবদুল গণি রোডের সেন্ট্রাল কমান্ড ও কন্ট্রোল ইউনিটে। ওই ভবনে থেকে রাজধানীর কয়েকশো পয়েন্টের ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করে পুলিশের মাঠের সদস্যদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের আদেশ দেয়া হয় সেখান থেকেই।
সেদিন ওখানে উপস্থিত থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য টিবিএসকে বলেছেন, সকাল থেকেই বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন ডিআইজি হারুন অর রশীদ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তিনি মাঠের পুলিশদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন, এবং মাঠের কর্মকর্তাদের বলছিলেন, সোমবারই হবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শেষ দিন, এরপর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এমনকি ঢাকার উত্তর পয়েন্টে ব্যারিকেড ভেঙ্গে যখন হাজারো জনতা শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল– তখনও তাদের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের আদেশ দেয়া হয়। ডিআইজি হারুন উত্তরার উপ-পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে উত্তেজিত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে বলেন বারবার। তবে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জানান, ‘স্যার অন্তত ২৫ হাজার মানুষ। এত মানুষকে অল্পসংখ্যক পুলিশের পক্ষে গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।’ এরপরও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও হারুন অর রশীদ পুলিশকে বলপ্রয়োগে বাধ্য করেন। পরে ছাত্রজনতা খিলক্ষেত পেরিয়ে বনানীর দিকে এগিয়ে গেলে– সেখানে ব্যরিকেড দিয়ে এপিসি কার থেকে পজিশন নিয়ে গুলি করার কথাও বলা হয়। তবে তাতে সায় দেননি বনানী ও গুলশানে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। দুপুর সোয়া দুইটা নাগাদ জনতার ঢল জাহাঙ্গীর গেট থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় অভিমুখে এগিয়ে গেলে– ওইরকম পরিস্থিতিতেও গুলির নির্দেশ আসে। তবে সেখানকার দায়িত্বরত সদস্যরা জানান ‘স্যার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আমাদের কিছুই করার নাই।’
এর মাঝে সেনাবাহিনী প্রধান দুপুরে ভাষণ দিবেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন হারুন অর রশিদ। আবদুল গণি রোডের সেন্ট্রাল কমান্ড ও কন্ট্রোল ইউনিটে থাকা অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এবার সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নিবে, অ্যাকশনে যাবে। আর চিন্তার কোন কারণ নেই।’ সে সময় অধস্তন কর্মকর্তারা বলেন, ‘স্যার আপনি মনে হয় পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না। সেনাবাহিনী কোনভাবেই বলপ্রয়োগ করবে না। আমাদের সমীকরণে কোথাও কোন ভুল হচ্ছে।’ ওই জুনিয়র কর্মকর্তাকে তখন ধমক দিয়ে সরিয়ে দেন হারুন অর রশিদ।
সবশেষ দুপুর আড়াইটা নাগাদ যখন জনতার ঢল গণভবনে ঢুকে পড়ে– সেই সময়ও সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ওয়াকিটকিতে গণভবন প্রটেকশন বিভাগের পুলিশ সদস্যদের বারবার ব্যবস্থা নিতে তাগাদা দেন। বলতে থাকেন, ‘ফোর্স তোমরা অ্যাকশনে যাও।’ ওয়াকিটকির অপর প্রান্ত থেকে আর কোনো উত্তর আসে না। এরমধ্যেই গণভবনে ঢুকে পড়ে জনতা। ক্লোজসার্কিট ক্যামরাতে এমন দৃশ্য দেখে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ধপাস করে চেয়ারে পড়ে যান হারুন অর রশীদ। তিনি এরপর দীর্ঘসময় আর কোনো কথা বলেননি, হয়ে পড়েন নিশ্চল।
এরপর কোথায় গেলেন হারুন অর রশীদ?
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে– লাখো জনতা সোমবার দুপুর থেকে নেমে আসে ঢাকার রাজপথে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, পোস্তগোলা দিয়ে প্রথমে শহীদ মিনার ও পরে গণভবনের উদ্দেশ্যে ঢলে অনেকে সচিবালয় ও বঙ্গবাজারের সড়ক দিয়ে এগোতে থাকেন।
ডিএমপির সেন্ট্রাল কমান্ড ও কন্ট্রোল ইউনিট ভবনের সামনে থাকা বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যানার টানানো দেখে উত্তেজিত জনতা ভবনটিকে উদ্দেশ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এর মধ্যেই পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ব্যানারটি সরিয়ে ফেলা হয় ও সামনের মূল ফটক আটকে দেয়া হয়। তবে জনতা ভবনটির প্রাঙ্গণে ঢুকতে না পারলেও– বাইরে থেকে মুর্হমুহু ইট মারতে থাকে। প্রাণভয়ে এর মধ্যেই অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তাদের ইউনিফর্ম খুলে ফেলেন। গেঞ্জি বা অন্য কোনো পোশাক পরে সেন্ট্রাল কমান্ড ও কন্ট্রোল ইউনিট ভবনের পেছনের প্রায় ১৩ ফুট দেয়াল টপকে পুলিশ সদর দপ্তরের সামনের রাস্তায় পড়েন। ঠিক একই কায়দায় দেয়াল টপকাতে গিয়ে পায়ে ও শরীরের নিচের অংশে ব্যাপক আঘাত পান ডিআইজি হারুন অর রশীদ। পরে সেখান থেকে তিনি আইজিপির সাথে চলে যান পুলিশ সদর দপ্তরে।
বিকালে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবারো পুলিশ সদর দপ্তর লাগোয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দেয়াল টপকে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে ফিরেন হারুন। ওইদিন রাতে তিনি কোথায় ছিলেন সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, তিনি কুটনৈতিক এলাকায় একটি দূতাবাসে/হাইকমিশনে আশ্রয় নেন।
২০০৬ সালে ডিভি লটারিতে আমেরিকার ভিসা পান হারুনের স্ত্রী। বৈধ ভিসা থাকায় সেই সূত্রে আমেরিকা পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। যোগাযোগ করেন মার্কিন দূতাবাসেও, নিশ্চয়তা চান তাকে অক্ষত অবস্থায় বিমানবন্দরে বিমানে তুলে দিয়ে আসার। তবে কূটনৈতিক সূত্র জানায়, তার প্রস্তাব নাকচ করে দেয় দূতাবাস। পরে তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন।
এরপর বিকালে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সোয়াটের একটি গাড়ি তাকে মিরপুরের দিকে একটি জায়গায় দিয়ে আসে। সেখানে কিছু ব্যক্তির সাথে আলাপ করে– বিমানবন্দর দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন হারুন। গাড়িতে করে পৌঁছেও যান বিমানবন্দরে। তবে বিমানবন্দের টার্মিনালে প্রবেশের আগেই জনতা তাকে দেখে চিনে ফেললে, মারধরের শিকার হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে। সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হারুন সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
সূত্র- টিবিএস