ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এক্সে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ নিয়ে গুজব

এক্সে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ নিয়ে গুজব

দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে গত সোমবার (০৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশৃঙ্খলার খবর সামনে এসেছে। এসব খবরের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপসানালয়ে হামলার ঘটনাও রয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ নিয়ে ছড়িয়েছে বেশ কিছু অপতথ্য।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান পরিষদ দাবি করেছেন, দেশের ২৯টি জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তবে দেশের প্রথম সারির একটি দৈনিকের প্রতিবেদন মতে, অন্তত ১২ জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির, ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট ভাঙচুর।

বাংলাদেশের এসব ঘটনা ভারতেও সামাজিক মাধ্যমে আসছে। তবে ডিসমিসল্যাব যাচাই করে দেখেছে, তাদের এসব পোস্টে বেশ কিছু পুরোনো ছবি এবং ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। ডিসমিসল্যাব এমন ছয়টি দাবি পেয়েছে, যেগুলো সমসাময়িক ঘটনার বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে। এক্সে ডেইলি লেটেস্ট আপডেটস অ্যাকাউন্ট থেকে চট্টগ্রামের নবগ্রহ মন্দিরে হামলার ঘটনা দাবিতে একটি ভিডিও পোস্ট হয়। ভিডিওতে দেখা যায় একটি মন্দিরের পাশে আগুন জ্বলছে। ভিডিওটি চট্টগ্রামের নবগ্রহ মন্দিরের এমন দাবি করে #AllEyesOnBangladeshiHindus এবং #SaveBangladeshiHindus দুটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়। এগুলো হিন্দুদের আক্রান্ত হওয়ার ইংগিত দেয়া হয়। ডিসমিসল্যাব এক্স-এর তথ্য থেকে বলছে, অ্যাকাউন্টটি ভারত থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তথ্য যাচাইয়ের সময় ফেসবুক ব্যবহারকারীর এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট পায় ডিসমিসল্যাব। পোস্টে বলা হয়, নবগ্রহ মন্দিরে হামলার দাবিটি একটি প্রোপাগান্ডা। যোগাযোগ করা হলে পোস্টদাতা ডিসমিসল্যাবকে জানান, চট্টগ্রামের লালদিঘী পাড় সংলগ্ন নবগ্রহ মন্দিরে কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি। তাকে এক্সে প্রচারিত ভিডিওটি পাঠানো হলে, তিনি বলেন যে এটি মূলত মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরের ঘটনায় সৃষ্ট আগুন। তিনি ডিসমিসল্যাবকে অক্ষত মন্দিরের ছবি পাঠিয়ে জানান, মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক স্বপন দাসও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। একই ভিডিওটি প্রচার হতে দেখা যায় ভারতের গণমাধ্যম রিপাবলিক টিভিতে। মঙ্গলবার (০৬ আগস্ট) রিপাবলিক বাংলার অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম করা হয়, “চট্টগ্রামে লালদিঘি পাড় নবগ্রহ মন্দির ভাঙচুর #shorts।” ভিডিওতে বলা হয় যে চট্টগ্রামের লালদীঘী পাড় নবগ্রহ মন্দিরে হামলা হয়েছে; যা সত্য নয়।

এদিকে হিন্দুদের দোকানে আগুন দেয়া হয়েছে এমন একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে সামাজিক মাধ্যম এক্সে। ভিডিওতে দেখা যায় একটি দোকানে আগুন ধরেছে এবং কিছু মানুষ আগুন থেকে মালামাল সরানোর চেষ্টা করছে। ভিডিওটি বুধবার (০৭ আগস্ট) পোস্ট হয়েছে, যেখানে ক্যাপশনে #AllEyesOnBangladeshiHindus -সহ একাধিক হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। এমন হ্যাশট্যাগ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার পর শুরু হয়েছে। এক্স-এর তথ্য অনুসারে, এই অ্যাকাউন্টটিও ভারত থেকে পরিচালিত হয়। ভারতীয় গণমাধ্যম সুদর্শন নিউজও এই ভিডিওটি প্রচার করে এটিকে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ বলে প্রচার করে। যাচাইয়ে দেখা যায়, ঘটনাটি সমসাময়িক নয়। মূল ভিডিওটি এই বছরের জুলাইয়ে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাটে আগুনে ১৫ টি দোকান আগুনে পুড়ে যাওয়ার ঘটনার। ঘটনাটির মূল কারণ জানা না গেলেও, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ঘটনাটি শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরে ঘটেনি, এবং এটি কোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নয়। উপরের দুটি ভিডিও একই দাবিতে বাংলাদেশের লোকেশন দেয়া একটি অ্যাকাউন্ট “ভয়েজ অফ বাংলাদেশী হিন্দুজ” থেকেও ছড়াতে দেখা গিয়েছে। ভয়েজ অব বাংলাদেশী হিন্দুজ নামক অ্যাকাউন্টটি থেকে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে একাধিক অপতথ্য ছড়ানোর নজির পাওয়া যায়। এইসব অপতথ্য নিয়ে একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

এছাড়াও, একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে করা পোস্টে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় লিটন দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পোস্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা এই আগুন দিয়েছে। যাচাইয়ে দেখা যায়, এই অ্যাকাউন্টটিও ভারত থেকে পরিচালিত হয় এবং আগুন জ্বলতে থাকা বাড়িটি লিটন দাসের নয়। মূলত শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর নড়াইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়ি পুড়িয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। ছবিটি সেই বাড়ির।

শুধু বাড়িতে আগুনের ঘটনায় নয়, ধর্ষণ হয়েছে এমন দাবিতে ভুয়া ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে এক্স। ছবিতে দেখা যায় যে এক ব্যক্তিকে অন্যরা বিছানায় শুইয়ে রেখেছে। শায়িত ব্যক্তির উপরিভাগে কোনো পোশাক দেখা যাচ্ছে না, এছাড়া ছবিতে শরীরের এই অংশের বেশিরভাগই রেখা টেনে ব্লার করে দেয়া হয়েছে। এক্স-এর তথ্য অনুসারে এই অ্যাকাউন্টটিও ভারত থেকে চালানো হয়। ছবিটি দিয়ে পোস্টে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জেরে হিন্দু নারীদের উপর ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে ভারতের তথ্য যাচাইকারী সংস্থা অল্টনিউজের করা একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় একই ছবি সামাজিক মাধ্যমে তখন ছড়িয়েছিল বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা বলে। ছবিটি বাংলাদেশেরও না। মূল ভিডিওটি ভারতের ব্যাঙ্গালোর শহরের এক ঘটনার।

এ ছাড়া একজন বাংলাদেশি হিন্দু ব্যক্তিকে মেরে একটি ভাস্কর্যের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এমন দাবি ছড়িয়েছে এক্স অ্যাকাউন্ট বাবা বানারস থেকে। অ্যাকাউন্টটি ভারত থেকে পরিচালিত হয় বলে তথ্য দিয়েছে এক্স। পোস্টের দাবিতে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গিরা একজন হিন্দুকে এভাবে হত্যা করেছে। তবে ডিসমিসল্যাবের একটি প্রতিবেদনে যুক্ত ভিডিওতে দেখা যায়, মরদেহটি কোনো হিন্দু ব্যক্তির নয়। এটি ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা ৯নং পোড়াহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরণের। ভারতের তথ্য যাচাইকারী সংস্থা ইন্ডিয়া টুডেও এই ভিডিওটি নিয়ে প্রতিবেদন করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাইরাল ভিডিওটিতে বাংলাদেশের একজন বয়স্ক হিন্দুকে পিটিয়ে হত্যা এবং ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না। বরং, এতে বাংলাদেশের ঝিনাইদহের মুসলিম আওয়ামী লীগ নেতা শহীদুল ইসলাম হিরণকে দেখা যাচ্ছে।

একই অ্যাকাউন্টের আরেকটি পোস্টে লেখা হয়, বাংলাদেশ থেকে বড় খবর! সারাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে! সারা বাংলাদেশে হিন্দুদের টার্গেট করা হচ্ছে! মুসলিম বিক্ষোভকারীরা হিন্দুদের বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করছে। মুসলিম উগ্রবাদীরাও হিন্দু মন্দিরে আগুন দিচ্ছে। ইসকন, কালী মন্দির সহ বহু মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৫০০ জন মারা গেছে এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে..।” এমন দাবি করে পোস্টটির সাথে যুক্ত করা হয়েছে তিনটি ছবি। এর মধ্যে একটি ছবি কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ এবং সরকার দলীয়দের সাথে সংঘর্ষের। তবে সংঘর্ষের আরেকটি ছবি ২০২১ সালের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের বিরোধিতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছিল। ছবিটি মূলত সেই সংঘর্ষের সময়ের। পোস্টটিতে মন্দিরের যে ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছে তাও সাম্প্রতিক কোন ঘটনার নয়। এই বছরের এপ্রিলে ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লী গ্রামের সর্বজনীন কালী মন্দিরে আগুন দেয়ার অভিযোগ উঠে। এই ঘটনায় সন্দেহের জেরে দুইজন নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। দেশজুড়ে আলোচিত এই ঘটনাটি কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর আগের ঘটনা। সাম্প্রতিক ঘটনা নয়। কালী মন্দিরের যে ছবিটি পোস্টে ব্যবহার করা হয়েছে এটি এপ্রিলের সেই ঘটনার সময়ের।

সংবাদটি শেয়ার করুন