দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩ শ্রমিক গুরুত্বর আহত হয়েছেন। বিকট শব্দে তাদের কান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঘটনার ৩ দিন পরও তারা ঠিকমতো শুনতে পারছেন না। অল্পের জন্যে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তারা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এই দূর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এবিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, গত রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারী) বেলা আড়াইটার দিকে কারখানার ওয়াগন শপে (উপকারখানা) একটি ট্রেনের বগির নিচে গ্যাস দিয়ে স্ক্রাপ প্লেট ও নাট কাটার কাজ করছিল খালাসী পদের ৩ জন শ্রমিক। এসময় হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পুরো শপ কেঁপে ওঠে এবং শ্রমিকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দিক বিদিক ছুটাছুটি করে।
এই ঘটনায় কর্মরত ৩ শ্রমিক গুরুত্বরভাবে আহত হয়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ২ জন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আর অন্যজন ছিটকে গিয়ে হত বিহ্বল অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রায় ১০ মিনিট পর অন্যান্য শ্রমিকরা এসে তাদের উদ্ধার করে দ্রুত সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু সেখানে নাক কান সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক না থাকায় বহিরাগত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আহত শ্রমিকরা হলেন, মো. রবিউল ইসলাম, মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. আনিসুর রহমান। তারা সবাই গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে খালাসী পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন। এখনও তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। এমতাবস্থায় এমন পরিস্থিতিতে তারা বেশ স্তম্ভিত। তবে কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক উদ্যোগ ও চিকিৎসার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বেশ সন্তুষ্ট।
দূর্ঘটনায় ৩ শ্রমিকের কেউ শরীরের বাহিরাংশের দিক থেকে জখমী না হলেও সবাই শ্রবণেন্দ্রিয়সহ হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কে আভ্যন্তরিণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। যে কারণে এখনো তারা কানে ভালোভাবে শুনতে পারছেন না। এমনকি হৃদপিণ্ডে ব্যাথা অনুভব করছেন। আর আতঙ্কের ঘোরমুক্ত হতে পারেননি। চিকিৎসক তাদেরকে ১৪ দিন সম্পূর্ণ বিশ্রামে রেখে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন।
বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারী) বেলা সাড়ে ১২ টায় সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালে গেলে আহত শ্রমিকরা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে থমকে যান। তারা দূর্ঘটনার বিষয়ে কোন কিছু বলতে দ্বিধা করেন। কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে তাদের সমস্যা হবে বলে জানান। তাই কি কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটেছে? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটুকু ছিল? এসব প্রশ্নের কোন জবাব দেননি তারা। এমনকি ছবি তুলতেও আপত্তি করেন। শুধু বলেন, আল্লাহ রক্ষা করেছেন।
তবে তারা আশ্চর্য হন যে, কি করে এই প্রতিবেদক দূর্ঘটনার খবর পেয়েছে। কারণ বিষয়টি একেবারে গোপন রাখা হয়েছে। এমনকি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা নামের একটি ফেসবুক পেজে ২ দিন পর দেয়া এসংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস অল্প সময়ের মধ্যে সরিয়ে ফেলা (ডিলিট করানো) হয়েছে। কিন্তু কেন এই লুকোচুরি? তা কর্তৃপক্ষ সংবাদ কর্মীদের খোলাসা করছেন না। ডিএস, ডাব্লুএম কেউই ফোন কথা বলছেন না।
আহত রবিউল ইসলাম বলেন, আমি ওয়াগনের (বগি) পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলাম। আনিসুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম বগির নিচে কাজ করছিল। হঠাৎ চরম শব্দে কেঁপে উঠি। লাফ দিয়ে প্রায় ৩ ফুট উপরে উঠে ছিটকে পড়ি। কান তালা লেগে গিয়েছিল। মাথার মধ্যে অস্বাভাবিক শো শো শব্দ হচ্ছিল। আশপাশের কিছুই শুনতে পারছিলাম না। বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছিল এবং হাত তুলতে কষ্ট হচ্ছিল।
চোখও অনেকটা ঝাপসা হয়ে পড়ে। তবে সামনে শুধু দেখছিলাম ট্রেনের নিচে আনিসুল ও সাইফুল নিথর হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু আতঙ্কে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে কিছুই ভাবতে বা কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এখনও ডান কানে ভালোভাবে শুনতে পারছিনা। বুকের ব্যাথাও আছে। স্যাররা প্রোপার ট্রিটমেন্টের সার্বিক চেষ্টা করছেন। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখানো প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।
আনিসুর রহমান বলেন, আমি বগির নিচে গ্যাস দিয়ে একটা নাট কাটছিলাম। আর সাইফুল হাতুর দিয়ে কাটা অংশে মাঝে মাঝে আঘাত করে সাহায্য করছিল। এসময় হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো শরীরে প্রচন্ড ধাক্কা৷ আর চোখ, কান, মাথা ও বুকে খুবই চাপ লাগে। ছিটকে পড়ে যাই। কোন রকমে হামাগুড়ি দিয়ে বগির নিচ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পারিনি। কি হলো কিছু বুঝে উঠার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
জ্ঞান ফিরলে দেখি হাসপাতালে। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানিনা। আজও কানে ঠিকমতো শুনতে পারছিনা। কাছে এসে না বললে কিছুই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছেনা। মাথা এখনো ঝিম ধরার মতো হয়ে আছে। বুকটাও বেশ ভার। শরীরে কোন ক্ষতচিহ্ন না থাকলে ভিতর থেকে আমরা খুবই দূর্বল হয়ে পড়েছি। ঘটনার আকস্মিকতা ও শব্দের তীব্রতায় সৃষ্ট বিহ্বলতা এখনো কাটেনি। এমন পরিস্থিতিতে পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য বিশ্রামের সাথে উপযুক্ত ও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, শব্দের মাত্রা এতই তীব্র ছিল যে মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে গেছি। বেঁচে যে আছি এটাই আল্লাহর রহম। কি থেকে কি হয়েছে আমরা বলতে পারবো না। তবে আমাদের কোন ত্রুটি ছিলনা। দূর্ঘটনা তো আর বলে কয়ে আসেনা। ঘটে গেছে। যে অবস্থায় আছি এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটতে পারতো। যেহেতু তেমন মারাত্মক কিছু হয়নি তাই সে বিষয়ে আর কোন কথা বলা ঠিক হবেনা। আমরা মাত্র ১০ মাস হলো চাকুরীতে যোগ দিয়েছি। এখনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম পাইনি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও নিশ্চিত করার দাবী জানান তারা।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র মতে, বরাবরের মতো শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলনা। আহত শ্রমিকরা কাজ করার সময় হাতে গ্লাভস পড়া থাকলেও মাথায় হেলমেট, পায়ে গামবুট, চোখে চশমা বা প্রোটেকশন গ্লাস ছিলনা। অথচ ওয়েল্ডিং বা গ্যাস কাটিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এসব থাকা একান্ত জরুরী। কিন্তু তা দেয়া হয়নি। তাছাড়া সিলিন্ডারে সংযুক্ত পাইপটি ছিলো পুরাতন ও টেপ পেচিয়ে জোড়াতালি দেয়া। সেখানে কোন লিক থাকায় আগুনের স্পর্শে এই জীবনঘাতি ঘটনা ঘটেছে। যা অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা জনিত।
সূত্র মতে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিবছরই পোশাকসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বাবদ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু সেই অর্থ যথাযথ ভাবে ব্যায় না করে নিম্নমানের উপকরণ দেয়ায় শ্রমিকরা তা গ্রহণ করেনা। বরং বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়ে তা দিয়ে কেউ কেউ বাহির থেকে নিরাপত্তা সামগ্রী কিনে। আবার কেউ খেয়ে ফেলে। আর প্রশিক্ষণার্থী শ্রমিকরা দুই বছর পর্যন্ত তা পায়না। সারা বছর শ্রমিকরা কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়না বা সরঞ্জাম ব্যবহারও করেনা।
অথচ এটা নিশ্চিত করেই এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা উচিৎ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে উদাসীন। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলে দেশের বৃহৎ সরকারি এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যক্রম। ফলে প্রায়ই ঘটে দূর্ঘটনা। গত মাসেও একই শপে দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে এক শ্রমিক। তিনি আজও কাজে যোগ দেয়ার জন্য সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। রেলওয়ে কারখানা শ্রমিকদের নিরাপত্তা ভাতা ব্যবস্থাও চালু নেই। জবাবদিহিতা না থাকায় এমন নানা অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে দীর্ঘদিন থেকে।
এসব বিষয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক (ডিএসডাব্লিউ) সাদেকুর রহমান কে একাধিক বার কল দেয়ার পর একবার রিসিভ করে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ‘আমি ছুটিতে বাইরে আছি’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এরপর আর কল ধরেননি। পরে কারখানার কর্ম ব্যবস্থাপক (ডাব্লিউএম) শেখ হাসানুজ্জামান কে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি কারখানায় গিয়ে দেখা করতে চাইলে গেইটে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। সেই সাথে হাসপাতালে শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে।