দুবাইভিত্তিক কোম্পানি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জের (এমটিএফই) ফাঁদে পড়ে সম্প্রতি সারাদেশে নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। সারা দেশের মতো বগুড়ায় অন্তত ২০০ জনের সিইও ছিলেন রাম মোহন দাস নামে এক ব্যক্তি, যার তত্ত্বাবধানে লেনদেন হতো ১০ কোটি টাকার ওপর। লাখ লাখ টাকা হারিয়ে আজ নিঃস্ব ভুক্তভোগীদের কেউই মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেননি বলে জানা গেছে।
প্রতারণার বিষয়টি তিনি নিজে বুঝতে পারেননি জানিয়ে এমটিএফই’র সিইও রাম মোহন দাস সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, আওতায় দুই শতাধিক হিসাব ছিল। এসব হিসাবে লেনদেন হতো ১০ কোটি টাকার ওপরে। তার নিজের বিনিয়োগ ছিল তিন লাখ টাকা। হঠাৎ ধনী হওয়ার আশায় সবাই বিনিয়োগ করেন। তবে তার দাবি, এ প্রতারক চক্রের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। এরপরও জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে আছেন।
জানা গেছে, বগুড়া শহরের রাজাবাজার ও নিউ মার্কেটের অন্তত ২০০ ব্যবসায়ী অনলাইনের মাধ্যমে এমটিএফই-তে বিনিয়োগ করেন। এদের সবার সিইও ছিলেন শহরের চেলোপাড়ায় বসবাসকারী রাম মোহন দাস। তিনি ছাড়াও এই শহরে ২০ জন সিইও ছিলেন। শাপলা মার্কেটের জেনারেটর মিস্ত্রি সুলতান তালুকদার অধিক লাভের আশায় এমটিএফই’র হিসাবে কয়েক হাজার ডলার সঞ্চয় করেন। ধনী হয়ে যাবেন তাই তিনি পুরাতন পেশা ছেড়ে দেন। সুলতান পাশের দোকানের ব্যবসায়ী রাজিব মণ্ডলের মাধ্যমে রাম মোহন দাসের খোঁজ পান। তাকে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়। চার মাস আগে তিনি সঞ্চয় করা দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। ওই অনলাইন হিসাবে প্রতি সপ্তাহে ৩০ হাজার টাকা লাভ যোগ হতে থাকে। এত লাভ দেখে তিনি কয়েক দিন পর স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে আরও ১০টি হিসাব খোলেন। তাদের জমানো ২০ হাজার ডলারের মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার উত্তোলন করতে পেরেছেন। মার্কেটের আরও অন্তত ৫০ জন ব্যবসায়ী এমটিএফই’র ফাঁদে পড়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন।
মাত্র ২০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিন শেষে পাঁচ হাজার টাকা লাভ পাওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়। এ আশায় নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা ও স্ত্রীর গহনা, ঘরের মূল্যবান সামগ্রী বিক্রি বা বন্ধক রেখে বিনিয়োগ করেন। সপ্তাহের শনি ও রবিবার বাদে পাঁচ দিন অ্যাপের মাধ্যমে ট্রেডিং হতো। সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকার ডলার অ্যাকাউন্টে ঢোকালে সপ্তাহে পাঁচ দিনের প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকার সমপরিমাণ ডলার লাভ দেওয়া হতো। অ্যাপটিতে ঢুকে শুধু একটি ফাঁকা ঘরে ক্লিক দিতে হতো। অ্যাপটি ব্যবহার সহজ হওয়ায় অশিক্ষিত লোকজনও চালাতে পারতেন।
বিনিয়োগের পর প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন ব্যবসায়ী আবুল কাশেম। তিনি বলেন, প্রথম সপ্তাহের পরে সেখান থেকে চার মাস আর ডলার তোলেননি। সর্বশেষ ১৭০০ ডলারের মতো জমা রাখেন। এখন নিজের ছাড়াও শিশু সন্তানের জমানো টাকাও হারিয়েছেন। পাপ্পু জিলাদার জানান, অন্যদের মতো প্রলোভনে পড়ে এক মাস আগে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে সব হারিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, শতাধিক বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করতে পারলেই তাকে সিইও পদ দেওয়া হয়। প্রত্যেক সিইওকে শহরে অফিস নেওয়ার জন্য প্রথমে দেড় লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতি শুক্রবার শহরের অভিজাত হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে লাভের টাকা দেওয়া হতো। সেখানে নামিদামি খাবার দেওয়া হতো। এসব সেমিনারে এমটিএফইতে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিনিয়োগের পদ্ধতি শেখাতো।
এদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে এমটিএফই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হওয়ার কথা শুনেছেন বলে জানান বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম ও সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের কেউ অভিযোগ দেননি। তাই এদের সংখ্যা ও বিনিয়োগের পরিমাণ বলা সম্ভব নয়। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।