অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার পর এ সংক্রান্ত খসড়া আইনে শাস্তিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
খাদ্যপণ্য অবৈধভাবে মজুতের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যদণ্ড রেখে খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২২ এর নতুন খসড়া করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়াটি প্রকাশ করে সবার মতামত নিচ্ছে মন্ত্রণালয়।
উক্ত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকার নির্ধারিত পরিমাণের বেশি খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে বা মজুত সংক্রান্ত সরকারের কোনো নির্দেশনা অমান্য করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে শর্ত থাকে যে, এ অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি আর্থিক বা অন্য কোনো লাভের উদ্দেশ্য ছাড়া মজুত করেছিলেন, তাহলে সর্বোচ্চ ৩ মাস কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে নতুন খসড়ায় উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৮ এপ্রিল এ আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকারের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম মন্ত্রিসভা। তখন এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
চাল, পেঁয়াজ, তেলসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্য খাদ্যপণ্যের অবৈধ মজুত ঠেকাতে এবং ইচ্ছামতো দাম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে বিদ্যমান আইন কঠোর করার উদ্যোগ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভেটিংয়ের সময়ে দেখা গেছে অপরাধ দমনে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ শাস্তি পর্যাপ্ত নয়। তাই সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়ে আইনের খসড়াটি ফের করা হচ্ছে। এরপর এটি মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিলে এটি সংসদে উত্থাপিত হবে।
‘মন্ত্রিসভায় যেটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সেই আইনের খসড়ায় সংশোধন আছে। সেই বিষয়ে মানুষের মতামত নেওয়া হচ্ছে।’ এমনই তথ্য জানান খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর যখন আইনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, তখন মনে হয়েছে যে উদ্দেশ্যে আইনটি করা হচ্ছে, সেই উদ্দেশ্য থেকে কিছুটা দূরে আছি। তাই আমরা আইনের খসড়া করে তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে আসলে নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আমরা আইনটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠাবো। আইনটি দীর্ঘমেয়াদী এবং ইফেকটিভ হওয়ার কথা। এ কারণে আমরা সময় নিয়ে আগাচ্ছি। কারণ এ আইন অনেক মানুষকে প্রভাবিত করবে এবং জনগণকে স্বস্তি দেবে। এজন্য আমরা চাচ্ছি আইনটি যাতে যথোপযুক্ত হয়। আমরা আইনে কোনো ঘাটতি রাখতে চাচ্ছি না।
উল্লেখিত নতুন এ আইন হলে ‘ফুড (স্পেশাল কোর্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৬’ ও ‘দ্য ফুডগ্রেইনস সাপ্লাই (প্রিভেনশন অব প্রিজুডিশিয়াল অ্যাকটিভিটি) অর্ডিন্যান্স ১৯৭৯’ বাতিল হয়ে যাবে।
এছাড়া খসড়ায় বলা হয়েছে, উৎপাদন বা বিপণন সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো অনুমোদিত জাতের খাদ্যশস্য থেকে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যকে ওই ধরনের জাতের উপজাত পণ্য হিসেবে উল্লেখ না করে ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বিপণন করেন, খাদ্যদ্রব্যের মধ্য থেকে কোনো স্বাভাবিক উপাদান সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অপসারণ করে বা পরিবর্তন করে উৎপাদন করেন বা বিপণন করেন বা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কৃত্রিম উপাদান মিশিয়ে উৎপাদন করেন বা বিপণন করেন-তবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, সরকার খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহকালে সরকারি গুদামে রাখা খাদ্যদ্রব্য বৈধ বা অবৈধভাবে সংগ্রহ করে, দেশে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে আমদানিকরা খাদ্যদ্রব্য বা সরকারি গুদামের পুরনো বা বিতরণ করা সিল বা বিতরণ করা হয়েছে এমন চিহ্নযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ভর্তি বস্তা বা ব্যাগ সরকারি গুদামে সরবরাহ করলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
খাদ্য অধিদপ্তরের বিতরণ করা সিল বা বিতরণ করা হয়েছে এমন চিহ্নযুক্ত সিল ছাড়া কোনো ব্যক্তি সরকারি গুদামের খাদ্যদ্রব্য ভর্তি বস্তা বা ব্যাগ বিতরণ, স্থানান্তর, কেনাবেচা করলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়।
খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন সম্পর্কিত কোনো ব্যক্তি কোনো মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি তৈরি, মুদ্রণ, প্রকাশ, প্রচার বা বিতরণ করলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
বিচার প্রকৃয়া: খসড়া আইনে বলা হয়, অপরাধের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদালত থাকবে, যার নাম হবে খাদ্যদ্রব্য বিশেষ আদালত।
এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন সরকার সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে খাদ্যদ্রব্য বিশেষ আদালত হিসাবে নির্ধারণ করতে পারবে। একাধিক আদালত নির্ধারণ করা হলে প্রত্যেকটি আদালতের জন্য স্থানীয় অধিক্ষেত্র নির্দিষ্ট করবে বলেও খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়।
আনন্দবাজার/কআ