চীন থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে বাংলাদেশে আসা এক ব্যক্তির ওমিক্রনের নতুন উপধরন বিএফ.৭ শনাক্ত হয়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গতকাল রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বিএফ.৭ আক্রান্ত একজনসহ করোনা আক্রান্ত চীনা নাগরিকের প্রত্যেকেই সুস্থ আছেন।
করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন প্রসঙ্গে নাজমুল ইসলাম বলেন, নতুন উপধরন নিয়ে আমরা ভীত নই। আমরা চাই না কেউ করোনা সংক্রমণ নিয়ে প্যানিক হয়ে যাক। কারণ আমাদের সংক্রমণের হার বর্তমানে ১ শতাংশেরও কম। তবে নতুন উপধরনকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি। সংক্রমণের হার যেন কোনোভাবেই বাড়তে না পারে। আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, দেশে ওমিক্রনের নতুন উপধরন বিএফ ৭ এর সংক্রমণ পাওয়া গেছে। প্রথম দফায় আসা চার জনের মধ্যে একজনের নমুনায় নতুন উপধরন পেয়েছি। আক্রান্ত ব্যক্তি আইসোলেশনে এবং সুস্থ রয়েছেন। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজনের ওমিক্রন বিএ ৫.২ উপধরন এবং আরেকজনের বিএ ৫.২.১ উপধরন শনাক্ত হয়েছে।
বিএফ.৭ না ছড়ানোর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, নতুন উপধরনকে আমরা খুব ক্লোজলি মনিটর করছি। সংক্রমিত দেশগুলো থেকে যারা আসছেন, তাদের নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। পরীক্ষায় যাদের নমুনা পজিটিভ পাচ্ছি তাদের আইসোলেটেড করছি। আরটিপিসিআর করছি। এই কার্যক্রমগুলো নিয়মিত চলছে।
এদিকে, চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করার পর দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিনিধিরা। গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে অন্য দেশগুলো যাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে সে জন্য করোনার সংক্রমণের চিত্রের হালনাগাদ তথ্য নিয়মিত জানাতে চীনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
হুর কর্মকর্তারা বলছেন, চীনে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। এতে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এ ছাড়া চীন করোনার সংক্রমণ–সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, সেখানে সংক্রমণ ও মৃত্যু কম হলেও কিছু হাসপাতাল ও মর্গে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধিদের সঙ্গে চীনের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকের পর ডব্লিউএইচওর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চীনের করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসা হয়েছিল। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে চীনকে আরও সহযোগিতা দিতে চাওয়া হয়েছে।
বৈঠকে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এবং জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার পক্ষ থেকে বেশ কিছু বিষয় ডব্লিউএইচওকে জানানো হয়েছে। করোনার টিকাদান কর্মসূচি, রোগীর সেবা, গবেষণা ও যোগাযোগ এবং ভেরিয়েন্ট কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, এসব বিষয়ে চীনের প্রতিনিধিরা ডব্লিউএইচওকে জানান। চীন ঝুঁকির মুখে রয়েছে এবং যাঁদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাঁদের টিকাদানের হার সম্পর্কে বৈঠকে জানতে চান ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধিরা।
ডব্লিউএইচওর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণের তথ্য, হাসপাতালের ভর্তি হওয়া রোগীদের শারীরিক অবস্থা, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকা রোগীদের অবস্থা ও মৃত্যুর তথ্যসহ করোনার মহামারির পরিস্থিতির সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানাতে আবারও চীনকে অনুরোধ করা হয়েছে। সম্প্রতি এসব তথ্য জানতে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি চীনের পক্ষ থেকে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে মিলেছে এক্সবিবি.১.৫ নামে করোনা ভাইরাসের নতুন এক ধরন। যা বেশ দ্রুত ছড়াচ্ছে। নতুন এ ধরনের সন্ধান মিলেছে ভারতেও। গত শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৪২ ভাগের দেহে নতুন এক্সবিবি.১.৫ ধরনের সন্ধান মিলেছে। এটি ওমিক্রনের একটি উপধরন। ২০২২ সালের নভেম্বরে সর্বপ্রথম করোনার নতুন ধরনটি সম্পর্কে জানান বিশেষজ্ঞরা। এরপর দ্রত সময়ের মধ্যে এটি যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দুই মাস পর গত শুক্রবার বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারতের গুজরাটে এক্সবিবি.১.৫ ধরনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়।ভারতে মাত্র কয়েকদিন আগে চীনে উৎপত্তি হওয়া বিএফ.৭ উপধরনেরও সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে দেশটিতে প্রবেশ করল আরেকটি ধরন।
এক্সবিবি.১.৫ ধরনটি বিএ.২.১০.১ এবং বিএ.২.৭৫ এর সমন্বয়ে গঠিত। যেটি কিনা ভারতসহ বিশ্বের ৩৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরন ওমিক্রনের অন্যান্য ধরন থেকে ভয়ংকর। ভারতের মহারাষ্ট্রের চিকিৎসক ড. প্রদীপ আওয়াতে জানিয়েছেন, তারা ভাইরাসটির নতুন ধরনের জেনেটিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। রাজ্যটিতে ১০০ শতাংশ জিনোমিক সিকোয়েন্সিং করা হচ্ছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে বিদেশ থেকে ভারতে আসা সবাইকে থার্মাল স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। এছাড়া দুই শতাংশ র্যান্ডম স্যাম্পলিং শুরু করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই চিকিৎসক। পরীক্ষায় যাদের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছে সেসব মানুষের নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, এটি সম্পূর্ণ আলাদা একটি ধরন। কীভাবে এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়।
অন্যদিকে, চীন থেকে আসা যাত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো। গত মঙ্গলবার থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। সম্প্রতি চীনে করোনার ব্যাপক সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, বেড়েছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। মরক্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, চীন থেকে আসা যাত্রীদের জাতীয়তা বা নাগরিকত্ব যাই হোক না কেন, তারা সবাই এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন।
অবশ্য নতুন করে করোনার মারাত্মক সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ইতালি, জাপান ও তাইওয়ান চীন থেকে আসা যাত্রীদের জন্য শনাক্তকরণ বা বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করেছে। মরোক্কর গণমাধ্যমগুলো বলছে, চীন থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক মরক্কো ভ্রমণ করেন। সাধারণত, মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্য দিয়ে আসা বিভিন্ন ফ্লাইটে তারা এখানে আসেন।
করোনা সংক্রান্ত কঠোর বিধি-নিষেধ বাতিলের পরপরই চীনে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায়, চীনের হাসপাতালগুলোতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। সেই সঙ্গে মরদেহ পোড়ানোর জন্য নির্ধারিত শ্মশানেও প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের ধারণা, এবার করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সিচুয়ান প্রদেশ ও রাজধানী বেজিংয়ের অর্ধেকেরও বেশি বাসিন্দা নতুন এ ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হয়েছেন। চীনা সরকারের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২০ দিনে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ। সে হিসাবে দৈনিক গড়ে ১ কোটি ২২ লাখ চীনা নাগরিক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
অন্যদিকে, করোনায় মৃত্যুর সংজ্ঞা বদলানোর পর চীনা কর্মকর্তারা ডিসেম্বর মাসজুড়ে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে চীনে দৈনিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪০ লাখ মানুষ। তবে বর্তমানের সংক্রমণ অতীতের যেকোনো রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, যা চীনকে করোনার চতুর্থ ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারি থেকে বাঁচার কৌশল সম্পর্কে জনগণকে সঠিক সময়ে তথ্য সরবরাহ করতে না পারা ও বয়স্কদের টিকাদানে ব্যর্থতার কারণেই চীনে নতুন করে করোনার এমন ভয়াবহ সংক্রমণ শুরু হয়েছে। জিরো কোভিড নীতি বাতিল করতে না করতেই চীনের করোনা পরিস্থিতির এমন ভয়াবহ অবনতি নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
চীনে নতুন করে করোনাভাইরাস ক্রমে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। দেশটির কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীনকে প্রয়োজনীয় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। তাইওয়ানকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ হিসেবে দাবি করে আসলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে তাইপে। দ্বীপটিতে মার্কিন কর্মকর্তাদের আনাগোনা ও সামরিক সহায়তা নিয়ে ক্ষুব্ধ বেইজিং। এ নিয়ে তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক চরমে পৌঁছেছে চীনের। এমন উত্তেজনার মধ্যেও চীনে করোনার সংক্রমণ বাড়ায় দেশটিকে সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট তাসাই ইং-ওয়েন। তবে দ্বীপের কাছে বেইজিংয়ের সামরিক শক্তি প্রদর্শন শান্তি ও স্থিতিশীলতার কাম্য নয়।
গত মাস থেকে চীনে প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও চীন জানিয়েছে, নতুন করে কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য দেবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তৃপক্ষ বলছে, তথ্য গোপন করছে চীন। চীনারা এখন র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট ব্যবহার করছেন সংক্রমণ শনাক্তের জন্য। এই পরীক্ষার ফলাফল কর্তৃপক্ষকে জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই। একই সঙ্গে সরকার উপসর্গ থাকা দৈনিক করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশও বন্ধ করে দিয়েছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিলের দিকে যাচ্ছে।
আনন্দবাজার/শহক