রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যোগাযোগের নতুন দিগন্ত

যোগাযোগের নতুন দিগন্ত

জনবহুল ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা বোধ হয় যানজট। এ যানজটের সমাধান করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে নির্মিত স্বপ্নের এই মেট্রোরেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে এবং ঢাকার যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে মেট্রোরেলব্যবস্থার যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর গণপরিবহনের এই নতুন দিগন্তের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। তবে সাধারণ যাত্রীদের মেট্রোরেলে উঠতে উদ্বোধনের পর আরও একদিন অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ উদ্বোধনের পরদিন থেকে টিকিট কেটে যাত্রীরা মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন। মেট্রোরেল উদ্বোধনের দিন দুই হাজার অতিথি নিয়ে অনুষ্ঠান হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। প্রধানমন্ত্রী প্রথম টিকিট কেটে ট্রেনে চড়বেন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

প্রথম দিকের পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলে ১৬টি স্টেশন থাকবে। অর্থাৎ দুটি স্টেশনের মধ্যে গড় দূরত্ব হবে ১ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার। বেশি স্টেশন রাখার ফলে বিপুলসংখ্যক যাত্রী এর সুফল ভোগ করবে। এই ১৬টি স্টেশন হচ্ছে- উত্তরার উত্তর, উত্তরা কেন্দ্র, উত্তরার দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। স্টেশনগুলো হবে ওপরে এবং নিচ থেকে লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে যাত্রীদের ওপরে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।

মেট্রোরেল পূর্ণ সক্ষমতায় ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এর গতি হবে গড়ে ঘণ্টায় ৩২ কিলোমিটার, যদিও এটি সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার চলতে সক্ষম। পিক আওয়ারে ৪ মিনিট পরপর একটি ট্রেন এবং অফ-পিক আওয়ারে ৭ মিনিট পরপর একটি ট্রেন চলবে। শীতকালে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ও গ্রীষ্মকালে সকাল ৫টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। মেট্রোরেল প্রকল্পের অবকাঠামো ১০০ বছরের জন্য ডিজাইন করা হবে। বৈদ্যুতিক ট্রেন ঝুলন্ত সিম্পল ক্যাটনারি ওয়্যার সিস্টেম থেকে ১৫০০ ভোল্টেজ ডিসি বিদ্যুতের সাহায্যে চলবে। ভোল্টেজের তারতম্য ৯০০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত।

মেট্রোরেলের নির্ধারিত রুট অনুযায়ী উত্তরা থেকে পল্লবী, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, প্রেস ক্লাব ও মতিঝিল পর্যন্ত যাবে। মেট্রোরেল পুরোটাই হবে উড়ালপথে। বিদ্যমান সড়কের মাঝখানে আড়াই মিটার জায়গা নেওয়া হবে। উচ্চতা হবে মাটি থেকে ৮-১৩ মিটার পর্যন্ত। ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক জানিয়েছেন, মেট্রোরেল চালু হলেও এটিতে যারা চলাচল করবেন তাদের সচেতনতার প্রয়োজন আছে। দরজা খোলা, টিকেট কাটার জন্য টিকিট কাটার জন্যও কিছুটা সময় দিতে হবে। তাই শুরুতে ট্রেন চলাচলের সময় ও যাত্রীসংখ্যা সীমিত হবে। আস্তে আস্তে ট্রেনের চলাচল বাড়বে, যাত্রীও বেশি করে তোলা যাবে।

আরও পড়ুনঃ  বাণিজ্যমন্ত্রীর নামে ফেসবুক একাউন্ট খুলে প্রতারণার অভিযোগে একজন গ্রেফতার

ইতোমধ্যে বহুল কাঙ্ক্ষিত মেট্রোরেলে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাড়া মওকুফ থাকবে। সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে। এক স্টেশন পর নেমে গেলেও ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। মেট্রোরেলে ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যাবে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। তখন মেয়াদকাল ছিল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৬ জুন নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার এই প্রকল্পে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে জাপানি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা- জাইকা। আর পাঁচ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করছে সরকার। নির্মাণকাজের উদ্বোধনের প্রায় সাড়ে ৬ বছর পর আগামী ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের সব কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ১২টি ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হলেও শুরুতে ১০টিতে সরাসরি যাত্রী পরিবহন করা হবে। বাকি দুটি যেকোনো সময়ে চলাচলের জন্য ব্যাকআপ হিসেবে ডিপোতে প্রস্তুত থাকবে। ট্রেন দুটি পরিচালনার জন্য কর্মকর্তারাও প্রস্তুত থাকবেন। এম এ এন ছিদ্দিক আরও বলেন, অন্যান্য দেশেও উদ্বোধনের পর প্রথম দিন থেকেই মেট্রোরেলে পরিপূর্ণভাবে যাত্রী পরিবহন করা হয় না। তাই শুরুতে কয়েক মাস কম যাত্রী পরিবহন করা হবে। পরবর্তী ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে শতভাগ যাত্রী পরিবহন করা যাবে।

আরও পড়ুনঃ  লাফিয়ে বাড়ছে ডলারের দাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল চলাচলে প্রচণ্ড শব্দ ও তীব্র কম্পনের ফলে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে মানববন্ধন করেছে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, মেট্রোরেল চলাচলে আশপাশে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হবে প্রশ্ন উঠেছে। তবে মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে কম্পন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। মেট্রোরেলের লাইনের নিচে এমএসএস (ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম) থাকবে। ম্যাস স্প্রিং সিস্টেমে বিশেষ ধরনের বিয়ারিং থাকে, যার কাজ হলো রেললাইনে যে কম্পন তৈরি হয় তা শোষণ করা। এর ফলে ট্রেন চলাচলের সময় আশপাশে তেমন একটা কম্পন অনুভূত হবে না।

মানববন্ধনে অংশগ্রহনকারী ছাত্ররা অভিযোগ করেন, মেট্রোরেল চলাচলে আশপাশে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হবে। অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান আরও বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণেরও বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে শব্দ তৈরির মাত্রা সাধারণ ট্রেনের চেয়েও কম, যা মানবদেহের জন্য সহনীয়। এখানে উল্লেখ্য, ৮৫ ডিবিএ মাত্রার শব্দ ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মানবদেহের জন্য সহনীয়। এ ছাড়াও মেট্রোরেলের চলাচল পথে কিছু এলাকায় শব্দ শোষণকারী দেয়াল থাকবে। এই দেয়ালের ফলে শব্দের মাত্রা আরও কমে আসবে।

মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক ট্রেনে যাত্রীরা চলাচল করবে। ভিভিভিএফ (ভেরিয়েবল ভোল্টেজ ভেরিয়েবল ফ্রিকোয়েন্সি) ইনভার্টার সিস্টেমে চালিত ট্রেন চলার সময় অনেক কম শব্দ তৈরি করে, যা শব্দদূষণের পর্যায়ে পড়ে না। মেট্রোরেল প্রকল্পটি চালু হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস ব্যবহারকারী অনেক যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করবে। এর ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ অনেক কমবে। বাসের ক্ষেত্রে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৫১ গ্রাম বা যাত্রী-কি.মি, ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ১৬৮ গ্রাম বা যাত্রী-কি.মি.। অন্যদিকে মেট্রোরেল যেহেতু বিদ্যুৎচালিত তাই বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ নেই বললেই চলে। এসব বিবেচনায় মেট্রোরেল অনান্য পরিবহন ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব।

রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, গণপরিবহন হিসেবে সাধারণ বাস দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় যানজট সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে বড় বিকল্প হচ্ছে মেট্রোরেল। বিশ্বের সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থা এই মেট্রোরেল প্রকল্প রাজধানীর যানজট সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনবে।

আরও পড়ুনঃ  গাজীপুরের কাপাসিয়ায় খিরাটী গ্রাম স্বেচ্ছায় লকডাউন

মেট্রোরেলের চালকের পদটির নাম ‘ট্রেন অপারেটর’। এই পদে ২৫ জনের সঙ্গে নিয়োগ পেয়েছেন মরিয়ম আফিজা। স্টেশন থেকে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন স্টেশন কন্ট্রোলার। এই পদে ৩৪ জনের সঙ্গে নিয়োগ পেয়েছেন আসমা আক্তার। ট্রেন অপারেটর কখনো কখনো স্টেশন কন্ট্রোলারের দায়িত্ব পালন করবেন। আবার স্টেশন কন্ট্রোলার প্রয়োজন হলে ট্রেন চালাবেন। মরিয়ম ও আসমা ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের হালিশহরে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনিং একাডেমিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে আরও চার মাস প্রশিক্ষণ নেন। প্রয়োজনে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের জাপানেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের।

মরিয়ম আফিজা, মেট্রোরেল অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নারী। মরিয়ম আফিজা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। লক্ষ্মীপুরের মেয়ে মরিয়ম নিয়োগ পেয়েছেন গত বছরের ২ নভেম্বর। তিনি বলেন, মেট্রোরেল বাংলাদেশে প্রথম। এই চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন আগ্রহ থেকেই। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল অনেকের মতো আমার কাছেও একটা স্বপ্ন। আমি নিজে ট্রেন চালাব- এটা ভেবে এখনই বেশ আনন্দ লাগছে। ‘মেট্রোরেল ব্যবস্থার প্রতি একটা প্যাশনও কাজ করেছে। এ জন্য প্রশিক্ষণে মেট্রোরেলের খুঁটিনাটি সবই রপ্ত করার চেষ্টা করছি।’

আসমা আক্তার, মেট্রোরেলের স্টেশন অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নারী আসমা আক্তার রাজধানীর তিতুমীর কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক করেন। স্টেশন কন্ট্রোলার পদে নিয়োগ পেয়েছেন ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট। তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে একটা চাকরি করব- শুধু এটা ভেবেই এখানে আসিনি। মেট্রোরেল ব্যবস্থার প্রতি একটা প্যাশনও কাজ করেছে। এ জন্য প্রশিক্ষণে মেট্রোরেলের খুঁটিনাটি সবই রপ্ত করার চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার পদ স্টেশন কন্ট্রোলার হলেও ট্রেন চালাতে হতে পারে। এটা আসলেই একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার।’ যানজটের নগরী ঢাকায় কোনভাবেই যখন যানজট নিরসন করা যাচ্ছে না, তখন স্বপ্নের মেট্রোরেল এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। মেট্রোরেল ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের অসহনীয় যানজটের অবসান করুক এই প্রত্যাশা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন