ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অধরা এক নীলবঙ্গ

অধরা এক নীলবঙ্গ

বাংলাদেশের পায়ের কাছেই আরেকটি বঙ্গ সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমায় অনাবিষ্কৃত বহুমুখী সম্পদের অবারিত ভাণ্ডার বঙ্গোপসাগর বা নীলবঙ্গ। চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক কর্মশালায় সমুদ্রের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিভিন্ন দিকে ও তথ্য তুলে ধরেছেন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। যেখানে বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনার দিক উঠে আসে। তবে বাংলাদেশ সবুজ অর্থনীতিতে যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে নীল অর্থনীতির বিশাল দিগন্তে সেই হিসেবে মনোযোগই দেয়া হয়নি।

মূলত সবুজ অর্থনীতি হচ্ছে কম কার্বন নিঃসরণ করে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা। আর নীল অর্থনীতি এমন একটি বিষয় যেখানে একটি দেশের সামুদ্রিক পরিবেশ কিংবা সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ও এর তলদেশের বিভিন্ন প্রকার সম্পদকে কাজে লাগানোর অর্থনীতি।

মূলত, বিশ্বের এক বিরল জলরাশি এবং ভূবিন্যাস নিয়ে গঠিত বঙ্গোপসাগর। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ফলে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমপরিমাণ টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের সম্পদের ওপর রয়েছে পুরো অধিকার।

এই সুবিশাল জলরাশির ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির এক অপার সম্ভাবনা। সমুদ্র উপকূল পরিবেষ্টিত পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে পাল্টে দিয়েছে তাদের অর্থনীতি। বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে বলছেন বিজ্ঞানীরা।

বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির অবদান প্রায় ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য। বাংলাদেশের বর্তমান সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির আয়ের ভেতর ২৫ শতাংশ আসে পর্যটন ও বিনোদন খাত থেকে, মাছ ধরা খাত থেকে আসে ২২ শতাংশ, যাতায়াত থেকে ২২ শতাংশ এবং গ্যাস ও তেল উত্তোলন থেকে আসে ১৯ শতাংশ। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি মাছ শিকার এবং ৬০ লাখ বাংলাদেশি সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরি ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে জড়িত। সব মিলিয়ে এ দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল।

বিশাল সমুদ্রসীমা থাকলেও গভীর সমুদ্রে যাওয়ার মতো সক্ষমতা নেই জেলেদের। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে প্রতিবেশি দেশগুলো মাছ ধরতে পারলেও পিছিয়ে রয়েছে এদেশের জেলেরা। ফলে অতি মূল্যবান টুনা মাছের বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। তাছাড়া গবেষণায় সক্ষমতা না থাকায় সম্পদের সঠিক হিসাব নিকাশও করা যাচ্ছে না। একই সময়ে সমুদ্রসীমা পেয়েও অনেক এগিয়ে যাচ্ছে ভারত ও মিয়ানমার। ভারত বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত করলেও বাংলাদেশ এখনো সেদিকে আগাতে পারেনি।

বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলীয় ১৯ জেলার মানুষ কোনো না কোনোভাবে সাগরের ওপর নির্ভরশীল। দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ, তার সমপরিমাণ (৮১ ভাগ) সম্পদ সাগরের তলদেশে রয়েছে। গবেষণা করলে এর কয়েকগুণ সম্পদের খবরও বেরিয়ে আসতে পারে। সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা-মাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। বিশ্বে ব্যবহৃত শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ম্যাগনেশিয়াম সামুদ্রিক পানি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই প্রাকৃতিক উৎস থেকে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়। এছাড়া সমুদ্রের বায়ু ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।

বাংলাদেশের ৭৫টি বহিঃদ্বীপ রয়েছে। যা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পর্যটন খাতে ব্যবহার করা সম্ভব। যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এসব সম্পদ গবেষণা এবং ব্যবহার সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খণিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনো সাগর, উপসাগরে নেই বলেও ধারণা করা হয়। আরো বহু বছর আগে মণি, মুক্তা, সোনা, রূপা, তামা, প্রবালসহ বিভিন্ন ধরনের মহামূল্যবান ধনরত্ন এখানে রয়েছে ধারণা করে, ভারতবর্ষের পৌরাণিকে বঙ্গোপসাগরের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রত্নাকাগার’।

বঙ্গোপসাগরে অপ্রাণিজ সমুদ্র সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। খনিজ সম্পদের মধ্যে প্রায় ১৭ ধরনের খনিজ বালি রয়েছে। এর মধ্যে বেশি পাওয়া যায় জিরকন, রুটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিকোক্সিন ইত্যাদি। যার প্রত্যেকটি পদার্থই মূল্যবান। তবে মোনাজাইট অতিমূল্যবান পদার্থ। এই তেজষ্ক্রিয় পদার্থ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ও পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তথ্যমতে, দেশের সমুদ্র সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খণিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। তাদের হিসেবে দেশের সমুদ্রসীমা থেকে প্রায় ১০ লাখ টন খণিজ বালু উত্তোলন করা যেতে পারে।

সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর তলদেশে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর বাংলাদেশের পাশেই প্রতিবেশী ভারত কৃষ্ণা গোধাবেরি বেসিনে ১০০ টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কারের কথা জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংস্থা ওএনজিসি। এছাড়া বাংলাদেশের কাছাকাছি মিয়ানমারের সাগর ভাগেও পাওয়া গেছে বড় গ্যাসক্ষেত্র। এ কারণে ভূতত্ত্ববিদদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায়ও বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে।

মৎস্য সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা, গুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর। দেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে ৪টি মৎস্যক্ষেত্র। যেখানে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া আরও আছে ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৭ প্রজাতির কচ্ছপ, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিন, প্রায় ২০০ প্রজাতির সি-উইড (এক ধরনের সামুদ্রিক ঘাস) রয়েছে বলেও মনে করেন অনেক গবেষক। তবে মাছ ধরতে বাংলাদেশের জেলেরা দেশি নৌযান নিয়ে মাত্র ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। অর্থাৎ তাদের কাছে সমুদ্রসীমার বড় একটা অংশই অজানা।

৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরে যাবার মতো মাছ ধরার কোনো নৌযানই নেই বাংলাদেশের। ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণের অনুমতি দেওয়া হলেও এখানো কোনো প্রতিষ্ঠান সমুদ্র গভীরে যেতে পারছে না। বঙ্গোপসাগরে আছে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আগাছা। এসব আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। এর মধ্যে পিরুলিনা সবচেয়ে মূল্যবান। চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে।

সমুদ্র অর্থনীতিকে যারা সফলভাবে কাজে লাগাতে পারছে তেমন দেশ, যেমন ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার এ সংক্রান্ত গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করে একটি সমুদ্র নীতিমালা প্রণয়ণ করা এখন সময়ের দাবি। সমুদ্রনির্ভর শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে পর্যাপ্ত বাজেটও বরাদ্দ করা দরকার। সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও গবেষণার পরিধি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। গবেষণা তথ্যকে সহজলভ্য ও নিরাপদ রাখতে একটি কেন্দ্রিয় ডেটা সেন্টার স্থাপন করার দাবি জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

সমুদ্র বিজ্ঞানের বিকাশে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংক্রান্ত বিভাগগুলোকে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগকারিদের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্লু ইকোনোমি ঘিরে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আকৃষ্ট ও আগ্রহী করা সময়ের দাবি। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-১৪ ‘জলের নিচে জীবন’ বাস্তবায়নে জোর দেয়া যেতে পারে।

জাতিসংঘের ১৪তম টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ‘জলের নিচের জীবন’ শিরোনামে বলা হয়েছে: টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর এবং সামুদ্রিক সম্পদসমূহ রক্ষা করা ও টেকসইভাবে ব্যবহার করাই আমাদের উচিত। আর বিশ্বব্যাংকের মতে, নীল অর্থনীতি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নততর জীবিকা সংস্থান এবং কাজের লক্ষ্যে সামুদ্রিক প্রতিবেশের উন্নয়ন; তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন সামুদ্রিক প্রতিবেশের সুরক্ষা ধ্বংস না হয়।

২০১২ সালের রিওডি জেনিরোতে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক জাতিসংঘ সম্মেলনে উত্থাপিত ‘ব্লু-ইকোনমি’র মূল উদ্দেশ্য ছিল জীবন মানের উন্নয়ন এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিশাল মানুষের খাবার জোগান শুধুমাত্র ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সম্ভব নয়। গবেষকরা বলছেন, বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দিতে বাধ্য হয়েই সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে সবাইকে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন