ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সড়কে নভেম্বরে নিহত ৫৫৪ জন! বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়

সড়কে নভেম্বরে নিহত ৫৫৪ জন! বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়

শুধুমাত্র নভেম্বরে সারা দেশে ৪৬৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৫৪ জন। একই সময় আহত হয়েছেন ৭৪৭ জন। নিহতের মধ্যে ৭৮ জন নারী এবং ৭১ জন শিশু রয়েছে।

একইসময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ৯০ শতাংশ। ১৯৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২২৯ জন। দুর্ঘটনায় ১২৩ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২২ দশমিক ২০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৯ জন, অর্থাৎ ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ।

রেলপথে ৮টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়েছেন। ৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত, ৭ জন আহত এবং ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

আজ (৪ ডিসেম্বর) সেফটি ফাউন্ডেশনের নভেম্বরের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। তারা ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

যানবাহনভিত্তিক দুর্ঘটনায় নিহতের চিত্র: পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২২৯ জন (৪১ দশমিক ৩৩ শতাংশ), বাস যাত্রী ২৮ জন (৫ দশমিক ০৫ শতাংশ), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-ড্রামট্রাক-মিক্সার মেশিন গাড়ি আরোহী ৩৪ জন (৬ দশমিক ১৩ শতাংশ), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার যাত্রী ৫ জন (০ দশমিক ৯ শতাংশ), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ৯৩ জন (১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-ঘাসকাটা মেশিন গাড়ি) ৩১ জন (৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-প্যাডেল ভ্যান আরোহী ১১ জন (১ দশমিক ৯৮ শতাংশ) নিহত হয়েছে।

সড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনা ধরন: বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৯২টি (৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৪৮টি (৩১ দশমিক ৯৬ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৪টি (১৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৪৩টি (৯ দশমিক ২৮ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি (১ দশমিক ২৯ শতাংশ) সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন: দুর্ঘটনাগুলোর ৮১টি (১৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২০৬টি (৪৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১২৬টি (২৭ দশমিক ২১ শতাংশ) পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দিয়ে, ৩৮টি (৮ দশমিক ২০ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করে এবং ১২টি (২ দশমিক ৫৯ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন: দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-পুলিশভ্যান ২২ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রাম ট্রাক-ডাম্পার ট্রাক-ট্যাঙ্ক লরি-মিক্সার মেশিন গাড়ি ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন-(নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-টমটম-মাহিন্দ্র-পাওয়ারটিলার-ধান মাড়াইয়ের মেশিন গাড়ি-ঘাস কাটার মেশিন গাড়ি) ৭ শতাংশ এবং বাই-সাইকেল-প্যাডেল রিকশা-প্যাডেল ভ্যান ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা: মোট ৭৫৭ টি। (ট্রাক ১২৫, বাস ৯৫, কাভার্ডভ্যান ১৮, পিকআপ ৩০, পুলিশভ্যান ১, ট্রলি ১৫, লরি ৬, ট্রাক্টর ৮, ড্রাম ট্রাক ৭, ডাম্পার ট্রাক ৩, ট্যাঙ্কলরি ৩, মিক্সার মেশিন গাড়ি ২, মাইক্রোবাস ১০, প্রাইভেটকার ১২, অ্যাম্বুলেন্স ৩, মোটরসাইকেল ২১৭, থ্রি-হুইলার ১২২ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৫৩ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-টমটম-মাহিন্দ্র-পাওয়ারটিলার-ধান মাড়াইয়ের মেশিন গাড়ি-ঘাস কাটার মেশিন গাড়ি) বাই-সাইকেল ৭, প্যাডেল রিকশা ১৪ এবং প্যাডেল ভ্যান ৬টি।

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে ভোরে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ, সকালে ৩০ দশমিক ০২ শতাংশ, দুপুরে ১৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ, বিকালে ১৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ, সন্ধ্যায় ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং রাতে ১৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ৩০ দশমিক ৬৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৩১ দশমিক ৪০ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ, প্রাণহানি ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, প্রাণহানি ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, প্রাণহানি ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৭ দশমিক ১২ শতাংশ, প্রাণহানি ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪ দশমিক ১০ শতাংশ, প্রাণহানি ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৮ দশমিক ২০ শতাংশ, প্রাণহানি ৯ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ২২ শতাংশ ঘটেছে।

সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। ১৪২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭৪ জন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৯টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ২৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ময়মনসিংহ জেলায় সবচেয়ে বেশি ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে মানিকগঞ্জ, নড়াইল, ঝালকাঠি, লালমনিরহাট ও রাঙ্গামাটি জেলায়। এই ৫টি জেলায় ১১টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনও প্রাণহানি ঘটেনি।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো হলো ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

দুর্ঘটনা কমাতে সুপারিশ: দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়াতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

পর্যালোচনা ও মন্তব্য: অক্টোবর মাসে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮২ জন নিহত হয়েছিল। সে হিসাবে নভেম্বর মাসে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নভেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, অর্থাৎ ১৯ জন। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪৪৬ জন, অর্থাৎ ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপসহ পণ্যবাহী দ্রুতগতির যানবাহন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী যানবাহন চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে।

আনন্দবাজার/কআ

সংবাদটি শেয়ার করুন