“দক্ষিণাঞ্চলে ফায়ার স্টেশনসহ দমকল বাহিনীর সব স্থাপনারই করুণ দশা। বেশির ভাগ ফায়ার স্টেশনের নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না তহবিল সংকটে। নানামুখি সীমাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণাতেও। অবকাঠামো ক্রমশ নাজুক হচ্ছে“
“দক্ষিণাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের বেশির ভাগের জন্য দায়ী বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট এড়াতে সব প্রতিষ্ঠান-স্থাপনাসহ আবাসিক ভবনে বিদ্যুৎ লাইন ও সব ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বিষয়ে বেশি সতর্ক হওয়ার পরামর্শ ফায়ার সার্ভিসের”
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও জনগণের জানমাল রক্ষায় পরিপূর্ণ প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি দক্ষিণাঞ্চলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। বরিশাল বিভাগীয় সদরে ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় শ্রেণির ফায়ার স্টেশনটি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে বছর দুয়েক আগে নগরীর কাশীপুরে আরেকটি নতুন ফায়ার স্টেশন স্থাপিত হয়েছে। তবে রূপাতলীতে অপর একটি প্রথম শ্রেণির দমকল কেন্দ্র আইনি জটিলতায় আটকে আছে।
এখনো বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালকের দপ্তর এবং ওয়ার্কশপ ছাড়াও ফায়ার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের বিষয়গুলো আলোর মুখ দেখেনি। পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির জনবল সংকটসহ অবকাঠামোর দুর্বল অবস্থা সঠিক সেবা প্রদানকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সূত্রমতে, দক্ষিণাঞ্চলের ৩টি প্রথম শ্রেণি ও ৩৫টি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ফায়ার স্টেশন ছাড়াও দুটি রিভার ফায়ার স্টেশনে মোট মঞ্জুরিকৃত প্রায় ৯৭৫ জনবলের মধ্যে দুই শতাধিক পদই শূন্য। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, জনবল নিয়োগ একটি নিয়মিত ও চলমান প্রক্রিয়া। অদূর ভবিষ্যতে এ সংকট বাহুলাংশে কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল মহল।
তবে সারাদেশের ন্যায় দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের জানমাল ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশাল সম্পদ রক্ষায় ফায়ার সার্ভিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও জনবল সংকটসহ নানামুখি সমস্যায় জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটির কাঙ্ক্ষি সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি এখনো পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দরের মত অতি জনগুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৪টি উপজেলায় দমকল বাহিনী পৌঁছতে পারেনি। আর পুরো বিভাগের ৬টি জেলা ও ৪২টি উপজেলাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি অ্যাম্বুলেন্সের বেশিরভাগই বিকল।
এমনকি নদীবহুল দক্ষিণাঞ্চলের দুটি রিভার ফায়ার স্টেশনের নৌ অ্যাম্বুলেন্স বিকল গত দুই দশক ধরে। সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ডুবুরি আছেন মাত্র ৩ জন। পটুয়াখালী রিভার ফায়ার স্টেশনে কোনো ডুবুরি নেই। অথচ প্রতিটি জেলায় ৬জন ডুবুরিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিট গঠনের সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে। খোদ বরিশাল বিভাগীয় সদরের একমাত্র রিভার ফায়ার স্টেশনে এখনো ৩০ বছরের পুরনো অগ্নি নির্বাপণ নৌযানটি চলছে জোড়াতালি দিয়ে।
প্রতিবছরই দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে প্রায় সাড়ে ৫শ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩০-৪০ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দমকল বাহিনীর প্রচেষ্টায় বিপুল সংখ্যক জীবনের পাশাপাশি শত শত কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু এরপরেও অধিক জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন এখনো দৃশ্যমান নয়। এমনকি এ অঞ্চলে শত শত সড়ক দুর্ঘটনা পরবর্তী হতাহতদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
গতবছর সড়ক দুর্ঘটনায় শতাধিক নিহত ও আরো প্রায় ৫ শত যাত্রী ও পরিবহন কর্মীসহ আহত সাধারণ পথচারী উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দমকল বাহিনী। এমনকি দুর্ঘটনার পর পরই সড়ক-মহাসড়ক সচল রাখতেও দমকল বাহিনী অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। তবে এখনো বরিশালের আগৈলঝাড়া, পটুয়াখালীর দুমকি ও রাঙ্গাবালীতে দমকল বাহিনী পৌঁছতে পরেনি।
মুলাদীর ফায়ার স্টেশনটির নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে ফায়ার স্টেশনসহ দমকল বাহিনীর সব স্থাপনারই করুণ হাল। বেশির ভাগ ফায়ার স্টেশনের নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না তহবিল সংকটে। এমনকি নানামুখি সীমাবদ্ধতায় সামান্য মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণও ব্যাহত হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে বেশির ভাগ ফায়ার স্টেশনের অবকাঠামোর অবস্থা ক্রমশ নাজুক হচ্ছে।
অপরদিকে, বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রায় ২৭ বছর পরে বরিশালে ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় দপ্তরসহ সরঞ্জাম মেরামত কারখানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ হলেও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে খুব অগ্রগতি নেই। দেশের সব বিভাগীয় সদরে ফায়ার সার্ভিসের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বরিশালের দপদপিয়া এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণের পরে চলতি অর্থ বছরে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও অবকাঠামো নির্মানের ‘প্রকল্প-সারপত্র’ই তৈরি হয়নি এখনো। আর নগরীর রূপাতলী এলাকায় একটি প্রথম শ্রেণির ফায়ার স্টেশন নির্মাণ প্রক্রিয়া আটকে আছে আইনি জটিলতায়।
গত ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিষয়টি নিয়ে নিম্ন ও উচ্চ আদালতের পরে এখন সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ১৯৫০ সালের দিকে বরিশাল শহরে দ্বিতীয় শ্রেণির একমাত্র ফায়ার স্টেশনটি বছর কয়েক আগে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হলেও এখনো অনেক উন্নত ও আধুনিক ফায়ার ফাইটার ইকুইপমেন্ট-এর অভাব রয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের বেশির ভাগের জন্য দায়ী বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট এড়াতে সব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাসহ আবাসিক ভবনে বিদ্যুৎ লাইন ও সব ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বিষয়ে অধিকতর মনযোগী হবার পরামর্শ ফায়ার সার্ভিসের।
এসব বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এর বরিশাল বিভাগীয় উপ পরিচালক জানান, দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো জেলা ও উপজেলায় দমকল বাহিনীর উন্নয়নে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিভাগীয় দপ্তরের ভূমি উন্নয়নের কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে বলেও জানান তিনি।