ঢাকা | শুক্রবার
২৩শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কান্নার নদী নাফ

কান্নার নদী নাফ
  • আয় না থাকায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ। ঠিকমতো খাবারও দিতে পারি না: নবী হোসেন, কানজরপাড়া, হোয়াইক্ষ্যং
  • ২৫ হাজার জেলে না খেয়ে থাকবে কেন, দ্রুত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানাই: রাশেদ মোহাম্মদ আলী, চেয়ারম্যান, হ্নীলা ইউপি
  • জেলেদের বিষয়টি আমরা প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করছি: মো. বদরুজ্জামান, জেলা মৎস কর্মকর্তা, কক্সবাজার
  • নাফ নদীর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি: মো. মামুনুর রশীদ, ডিসি, কক্সবাজার

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ও ইয়াবা পাচার রোধ করতে গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। এই নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহকারী জেলে পরিবারের ২৫ হাজার লোকজনের দুর্বিষহ জীবন কাটছে। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে উখিয়ার পালংখালী পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার নাফ নদীতে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর ধরে মাছ ধরা বন্ধ। হাজার হাজার জেলে বেকার। মানবেতর জীবন যাপন করছেন ২৫ হাজার জেলে। অনাহার অর্ধাহারে থাকতে থাকতে অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছে। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়েছে। অনেকে বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় বিছানায় কাতরাচ্ছে।

সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার নাফ পাড়ের পেশাদার জেলেরা। এসব হতদরিদ্র জেলেদের অভিযোগ গেল সাড়ে পাঁচ বছরে কেউ তাদের খবর রাখেনি। সরকার, জনপ্রতিনিধি, এনজিও, আইএনজিওর কোনো সহায়তা তারা পায়নি। তাদের সন্তানরা অধিকাংশই শিক্ষা দীক্ষা থেকে বঞ্চিত। পেটের তাগিদে অনেক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে একমুঠো অন্ন জোগাতে নিরন্তর সংগ্রাম করছে। শত শত শিশু গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছে। এ অবস্থায় তারা জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে  সাগরপথে মালেশিয়া ও চলে যাচ্ছে।

মূলত, রোহিঙ্গা ঢল ও ইয়াবা পাচারের অজুহাতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে ভাগ করা নাফ নদীতে সরকার ২০১৭ সালে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে পেশাজীবী জেলেরা পড়েন মহাসংকটে। তাই ভাতের অভাব আর বিনা চিকিৎসায় কাটছে তাদের জীবন। মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার জেলে এরপর থেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।

নদীর পাড়ের জেলেরা জানায়, তাদের পূর্বপুরুষ সূত্রে পাওয়া একমাত্র পেশা মাছ ধরা। কিন্তু হঠাৎ মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। স্থানীয় শ্রমবাজারও রোহিঙ্গারা দখল করায় সবদিক থেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। অর্থাভাবে তাদের বেঁচে থাকাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ভাতের অভাব দূর করতেই চিন্তা করতে হয়, সেখানে সন্তানদের পড়াশোনা করানোর কথা ভাবতে পারেন না।

টেকনাফ জেলে পাড়ার স্থানীয় জেলে সাধনদাস বলেন, নাফনদীর কিনারায় বসতি হওয়ায় বাপ-দাদার আমল হতেই আমাদের পরিবার মাছ শিকার করেই সংসার চালিয়ে এসেছে। নাফ নদীতে সব সময় পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়। তাই মাছ শিকার ছাড়া অন্য কোনো পেশায় অভ্যস্ত হয়নি। এখনও নতুন পেশায় অভ্যস্ত হতে না পেরে বিগত সাড়ে পাঁচ বছর আমাদের মতো শত শত জেলে পরিবার মানবেতর জীবন পার করছে। এ সব জেলেদের ফরিয়াদ নাফ নদীর তীর ঘেঁষে থাকা পাঁচ সহস্রাধিক পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার নাফ নদীতে মাছ শিকারের সুযোগ দিক।

আরেক জেলে আব্দুল করিম বলেন, রোহিঙ্গাদের কথা সবাই চিন্তা করে কিন্তু আমাদের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও ইয়াবার অজুহাতে নাফ নদীতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, কিন্তু এখনও কি ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়েছে। উল্টো আরও বেড়েছে। এখনো কোনো না কোনো সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নতুন নতুন রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। যারা পার হতে পারছে না তারা শূন্যরেখায় জড়ো হচ্ছে। সেখান থেকেই করছে যত অপকর্ম।

টেকনাফ হোয়াইক্ষ্যং কানজরপাড়ার নবী হোসেন নামে এক জেলে বলেন, প্রায় সাড়ে পাঁচবছর ধরে মাছ শিকার বন্ধ। তার মধ্যে তেমন সরকারি সহায়তাও পাইনি। এতোদিন আমরা কীভাবে চলছি সেটার খবর কেউ রাখেনি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও বন্ধ। ঠিকমতো ছেলেমেয়েদের মুখে খাবারও দিতে পারি না। এক বেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। যদি সরকার নাফ নদীতে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেয় তাহলে না জানি আমাদের কপালে আরো কত দুঃখ আছে।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, যে কারণে মাছ ধরা বন্ধ করা হয়েছিল সেই ইয়াবা পাচার এখনও বন্ধ হয়নি নাফ নদীতে। তাহলে কেন টেকনাফ উখিয়ার ২৫ হাজার জেলে না খেয়ে থাকবে? দ্রুত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানান তিনি।

এদিকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, নাফ নদীর জেলেদের সহায়তার জন্য এখন পর্যন্ত আলাদা করে কোনো কর্মসূচি নেয়া হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জেলেদের বিষয়টি অবগত করছি।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, নাফ নদীর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। বর্তমানে সীমান্ত পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত। এই মুহূর্তে নাফ নদী খুলে দেয়া যৌক্তিক সময় না।

জেলেদের দাবি, নাফ নদীতে নিষেধাজ্ঞার ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ২৫ হাজার জেলের একবারও খোঁজখবর নেয়নি কোনো জনপ্রতিনিধি ও সরকার। নিরাপত্তা জোরদার করে জেলেদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হোক নাফ নদী। এমন দাবি স্থানীয়দেরও। কারণ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দিলেই যে, ইয়াবা পাচার বন্ধ হবে এমন ধারণা মোটেই যুক্তিসংগত নয় বলে মনে করেন উখিয়া টেকনাফের জনপ্রতিনিধিরা। তারা মনে করেন নাফ নদীতে নৌযান চলছে, সীমান্ত বাণিজ্য সচল রয়েছে। স্থলবন্দর চালু আছে। মায়ানমার সীমারেখায় মাছ ধরা বন্ধ হয়নি। শুধু শুধু বাংলাদেশি সীমান্ত পারের জেলেরা পড়েছেন নিষেধাজ্ঞার কবলে। এ সমস্যা  থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন জেলেরা।

সংবাদটি শেয়ার করুন