- “এমনিতেই বৈশ্বিক জলবায়ুর মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে, তার ওপর আমাজনকে ধ্বংস করতে থাকলে পৃথিবীর অস্তিত্বেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে“
- সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর শাসন মেয়াদে আমাজনে কার্বন নিঃসরণ দ্বিগুণ হয়েছে: লুসিয়ানা গাত্তি, গবেষক, আইএনপিই, ব্রাজিল
- ব্রাজিল এখন জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত। আমাজন উজাড়ের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে কাজ করবো: লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, নতুন প্রেসিডেন্ট, ব্রাজিল
পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত বন আমাজন। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদী বিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের বৃহৎ চিরহরিৎ বনভূমি। প্রায় ৭০ লখের বেশি বর্গকিলোমিটার নদী অববাহিকা পরিবেষ্টিত আমাজন জঙ্গলের আয়তন প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার। আর্দ্র জলবায়ু প্রভাবিত বিশাল এই অরণ্য ব্রাজিলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেশির ভাগ এলাকাসহ কলম্বিয়া, পেরুসহ দক্ষিণ আমেরিকার ৯টি দেশে বিস্তৃত। যদিও এই বনের সিংহভাগ প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি পড়েছে ব্রাজিলে। পৃথিবীর এই ফুসফুসকে সংরক্ষণ আর রক্ষণাবেক্ষণের দায় তাই ব্রাজিল সরকারের ওপরেই বর্তায়। দেশটির পরিবেশবান্ধব নীতির ওপরেই নির্ভর করে আমাজনের ভাগ্য।
এক সময় ফুটবলখ্যাত দেশ ব্রাজিলকে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখা হতো। তবে বিগত প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন। তার আগে গত দুই দশকের বেশির ভাগজুড়ে দেশটিকে আদিবাসীদের ভূমি সংরক্ষণ, অবৈধভাবে বন উজাড়কারীদের ধরপাকড় চলেছে। সেই সঙ্গে কী পরিমাণ বন ধ্বংস হচ্ছে, তা আরও বেশি করে পর্যবেক্ষণ করতেও দেখা গিয়েছিল। আর এসব পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আমাজন বন উজাড়ের হার উল্লেখজনকভাবে কমে এসেছিল। তবে প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর সরকার এসে বন ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠে। যা অতীতের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত অক্টোবরের মধ্যে আমাজনের ৯ হাজার ৪৯৪ বর্গ কিলোমিটার (তিন হাজার ৬৬৬ বর্গ মাইল) জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ১২ গুনেরও বেশি। তার আগে ২০১৯ সালে আমাজনের ৯ হাজার ৬০ বর্গ কিলোমিটার (তিন হাজার ৫০০ বর্গ মাইল) জায়গা থেকে গাছপালা পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল।
এছাড়া ব্রাজিলিয়ান মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র গত ১২ নভেম্বর সরকারি স্যাটেলাইট থেকে আমাজনের বেশ কয়েকটি ছবি সংগ্রহ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, গত অক্টোবরের মধ্যে আরও প্রায় ৯০৪ বর্গ কিলোমিটার বন কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে পর্যবেক্ষণ বা তদারকি শুরু হওয়ার পর এই প্রথম এত বেশি পরিমাণ বন ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মূলত, ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জইর বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ক্রমাগত আমাজন জঙ্গল ধ্বংসের হার বাড়তে দেখা গেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর বলসোনারো ব্রাজিলের পরিবেশের সুরক্ষাজনিত পদক্ষেপগুলো কমিয়ে ফেলেন। বিজ্ঞান ও পরিবেশগত সংস্থাগুলোতে খরচ কমিয়ে দেন। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের বরখাস্ত করেন। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নড়বড়ে করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। বন উজাড় করে এসব এলাকাগুলোকে কৃষি জমিতে পরিণত করেন বলসানারো। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বারবারই অভিযোগ করেছে, বলসোনারোর সরকার স্থানীয় কৃষকদের আমাজনে আগুন দিতে উৎসাহ দিয়েছে।
এক গবেষণা মতে, বন উজাড় এবং আগুনের কারণে আগের দশকের তুলনায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমনের হার দ্বিগুণ হয়েছে। সবশেষ একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালে আমাজনের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর এলাকা আগুনে পুড়ে গেছে। সেপ্টেম্বরে বনে আগুনের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্রাজিলের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (আইএনপিই) গবেষক লুসিয়ানা গাত্তি বলেন, বলসোনারো সরকারের অধীন আমাজনে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমনের হার দ্বিগুণ হয়েছে।
ব্রাজিলের আইএনপিই-এর জলবায়ুবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক লুসিয়ানা গাত্তির নেতৃত্বাধীন এক গবেষণায় দেখা গেছে বলসোনারোর শাসন মেয়াদে আমাজন জঙ্গলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং প্রচণ্ডরকম বন উজাড় করার কারণে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। গাত্তি বলেন, এতে যে শুধু ব্রাজিলের জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তা নয়, এর মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বই বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ছে। আইনিব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা কমে যাওয়ায় পরিবেশবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির বোধ তৈরি হয়েছে।
সূত্রমতে, ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বলসোনারোর শাসন মেয়াদের প্রথম তিনবছরে আমাজনের ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা উজাড় হতে দেখা গেছে। এ সময় আগের ৩ বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি বন এলাকা উজাড় হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দাবানলে ধ্বংস হওয়া বন এলাকাকে বাদ দিয়ে এ হিসাব করা হয়েছে।
গাত্তির দলের গবেষণা প্রতিবেদনটি নেচার সাময়িকীর পর্যালোচনাধীন। গবেষণার আওতায় দশক ধরে আমাজন বনের ওপর দিয়ে ছোট ছোট উড়োজাহাজ উড়িয়ে বাতাসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গড় কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমন হারের তুলনায় ২০১৯ সালে কার্বন ডাই–অক্সাইডের নির্গমন হার ৮৯ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১২২ শতাংশ বেড়েছে।
২০২০ সালে কার্বন নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো ওই বছর বন উজাড়ের হার ৭৪ শতাংশ এবং আগুনে পুড়ে যাওয়া বনের এলাকার পরিমাণ ৪২ শতাংশ বেড়ে যাওয়া। আবার একই বছরে পরিবেশ–সম্পর্কিত অপরাধের ঘটনায় জরিমানা আদায়ের পরিমাণ ৮৯ শতাংশ কমেছে। কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধের ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করার হার ৫৪ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে।
স্থানীয় অধিকারকর্মীরা দেশটির পরিবেশ ও আদিবাসীদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলার জন্য বলসোনারোকে ব্যাপকভাবে দায়ী করেন। তারা দাবি করেন, বলসোনারোর এমন সিদ্ধান্তেই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বন উজাড় ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদন বলছে, প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর আমলেই ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে আমাজন। তার প্রশাসনের দ্বারাই বনটির বিস্তর অঞ্চল পুড়িয়ে ফেলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে। সেই সময় বলসোনারো প্রশাসন বলেছিল, দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে আমাজন পরিষ্কার আরও বেশি মাইনিং (মূল্যবান পদার্থের খনি খনন) ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প করা হচ্ছে।
গত অক্টোবরের শেষ সপ্তায় ব্রাজিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরিবেশবিরোধী ও বিতর্কিত জইর বলসোনারোকে পরাজিত করে জয় লাভ করেছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। আসছে বছরের ১ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন তিনি। অ্যামাজন বন নিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট লুলার অঙ্গীকার পরিষ্কার। নির্বাচনের আগেই আমাজন বন রক্ষায় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
লুলা দা সিলভা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ক্ষমতায় গিয়ে আমাজন ধ্বংস বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বনটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে তাদের আরও শক্তিশালি করে তোলা হবে। নির্বাচনে জয়লাভের পর বলেছেন, ব্রাজিল এখন আমাজন রক্ষার মাধ্যমে জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত। বন উজাড়ের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কাজ করবে তার প্রশাসন।
তবে অনেকেই বলছেন নতুন সরকার আসার আগেই আমাজন বন ধ্বংসের প্রবণতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। যার প্রভাব আরও সুদূরপ্রসার হবে। অনেকের মতে, এমনিতেই যে হারে বৈশ্বিক জলবায়ুর মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে, তার ওপর আমাজনকে এভাবে ধ্বংস করতে থাকলে পৃথিবীর অস্তিত্বে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অনেকেই আবার অতীতের তথ্য তুলে ধরে আশঙ্কার কথাও বলছেন। কেননা, আইএনপিই-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৪ সালে আমাজন জঙ্গলের ২৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হতে দেখা গিয়েছিল। তবে ২০১২ সাল নাগাদ বন ধ্বংসের এলাকা কমে ৪ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। পরবর্তী কয়েক বছরেও বন ধ্বংসের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কমতে দেখা গেছে। আর ২০০৪-২০১২ সালের মধ্যে বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় ছিলেন লুলা।