সুপার সাইক্লোন সিডরের ১৫ বছর পূর্তি আজ। ২০০৭ সালের এ দিনে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আঘাত হেনেছিল এই ট্রপিক্যাল সাইক্লোন। এর ধ্বংসলীলায় মুহূর্তেই পাল্টে যায় উপকূলীয় জনপদের জীবন। সেই দুঃসহ স্মৃতিতে এখনও আঁতকে ওঠে মির্জাগঞ্জের মানুষ ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সিডরের আঘাতে মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ১১৫ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়নের চরখালী গ্রামেই নারী, পুরুষ ও শিশুসহ প্রাণ হারায় অর্ধশতাধিক মানুষ, আহত হয় সহস্রাধিক মানুষ। এছাড়াও উপজেলায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। আংশিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয় ১৪ হাজার ৫শত, গবাদি পশু মারা যায় ২ হাজার ৫ শত, হাঁস-মুরগি মারা যায় ১ লাখ ৩০ হাজার, ফসল বিনষ্ট হয় ১১ হাজার ৯৯০ একর জমির, ৭৯৮৭টি পুকুরের প্রায় কোটি টাকার মাছ ভেসে যায়, এছাড়াও উপজেলা ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ২৪০টি মসজিদ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ৩৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ১৫৬ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক ও ৩৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মির্জাগঞ্জে সিডরের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপজেলার চরখালী গ্রাম। এই গ্রামটি পায়রা নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত। এই গ্রামে সিডরের কয়েক বছর আগে থেকেই এই গ্রামের বেড়িবাঁধ ছিল নড়বড়ে অবস্থায়। যার ফলে খুব সহজেই পানি ঢুকে পড়ে ওই এলাকায়। সিডরের সময় এ জায়গায় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ২০ ফুটের মতো।
ঘূর্ণিঝড়ের পরদিনই সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে তলিয়ে ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোনো জায়গাও পাওয়া যাচ্ছিল না।
লাশগুলো আনা হয় ওই গ্রামের খাঁন বাড়ির পুকুর সংলগ্ন ফাকা জায়গায়। সেখানেই বরগুনা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে পুকুরের পাড়ে উঁচু জায়গায় সারিবদ্ধভাবে লাশগুলো দাফন করা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আর্থিক সহযোগিতায় লাশগুলো দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সিডরের ১৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও সীমানা প্রাচীর দিয়ে গণকবরটি সংরক্ষণের কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় বর্তমানে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। দ্রুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে গণকবরটি সংরক্ষণসহ সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান নিহতদের স্বজন ও স্থানীয়রা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গণকবরটির চারপাশ ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যাচ্ছে। শুধুমাত্র সামনে একটি প্রাচীর থাকায় অন্য পাশ দিয়ে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি অবাধে বিচরণ করছে। পাশেই আবার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে। দেখলে বোঝার উপায় নেই এটি একটি গণকবর।
স্থানীয় বাসিন্দা ও চরখালি সমবায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা খান বলেন, টেকসই বেড়িবাধ না থাকার কারণে সিডরে এই এলাকার এত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর পরেও অনেকগুলো বন্যা হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত টেকসই বেরিবাধ নির্মাণ হয়নি। যদি দ্রুত টেকসই বেড়িবাধ নির্মান করা না হয় তাহলে আবারও সিডরের মত কোন বন্যা হলে এই এলাকায় ব্যাপক ত্রানহানি ঘটবে। এছাড়া সিডরের রাতে নিহতদের গনখবরটি এখন নিশ্চিহ্নের পথে। এ কবরটি সংরক্ষণ করতে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা কোন রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নিতে দেখিনি। দ্রুত এ গণকবরটিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে সংরক্ষণ করা না হলে অচিরেই এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
সিডরের রাতে বাবা-মা হারানো মেয়ে নিপা আক্তার বলেন, সিডরের সময় আমি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। ওই রাতে হঠাৎ আমাদের বাসায় পানি উঠলে বাবা-মা আমাদেরকে মাচায় উঠিয়ে দেয়। হঠাৎ পানির ধাক্কায় আমাদের ঘরটি ভেঙ্গে চুরে যায় এবং আমাদেরকে পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন আমিসহ আমাদের বাড়ির ১৭ জন লোক একটি গাছের ডাল ধরে থাকি। পরদিন সকালে আমাদেরকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। দুইদিন পর আমাদের বাড়ির পাশে ধানক্ষেতে আঁকড়ে ধরা অবস্থায় বাবা-মা লাশ পাওয়া যায়। সেইসব স্মৃতি মনে পড়লে এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোসা. তানিয়া ফেরদৌস বলেন, যে সকল সরকারি দপ্তর কবর সংরক্ষণ ও কবরস্থান নির্মাণ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের মাধ্যমে এটির প্রাচীর নির্মাণ এবং সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান খান মোঃ আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, টেকসই বেড়িবাদ না থাকার কারণে সিডরে মির্জাগঞ্জে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। মির্জাগঞ্জের চারটি ইউনিয়নই পায়রা নদীর কোল ঘেষা। কিন্তু সিডরের ১৫ বছর পার হলেও এখনো টেকসই বেরিবাধ নির্মাণ হয়নি। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই যাতে এই উপজেলায় উন্নতমানের টেকসই ও ব্লকের মাধ্যমে বেরিবাধ নির্মাণ করা হয়। যাতে উপজেলাবাসি বন্যার হাত থেকে রক্ষা পায় এবং প্রাণহানি না ঘটে।