বরিশালে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একাধিক ইটভাটায় অবাধে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে গত মৌসুম থেকে কয়লার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বরিশালের অধিকাংশ ইটভাটার মালিক পুরনো সনাতন পদ্ধতি ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে কাঠ দিয়ে ইট পুড়তে শুরু করেছে। এতে একদিকে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ, অন্যদিকে ভাটার কালো ধোঁয়ায় আশপাশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অনেক ফলের গাছ মরে যাচ্ছে। সড়ক পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকার নদীর চর ও তীরে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই ইটভাটাগুলো অবৈধভাবে গড়ে তুলছে মৌসুমি ইট ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বাসা-বাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে বিধি-নিষেধ না মেনেই অবৈধভাবে ইটভাটাগুলো গড়ে উঠছে। এতে এ অঞ্চলের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
এসব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে গতবছর বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও ভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হলেও এই বছর পুনরায় সেই ইট ভাটা চালু করছে অবৈধ ইট ব্যবসায়ীরা। ভুক্তভোগীদের দাবি, লোকালয়ের ইটভাটা বন্ধ করার পাশাপাশি সরকারের বেঁধে দেয়া শর্তাবলী শতভাগ পূরণ না হলে লাইসেন্স বাতিল করা হোক। অপরদিকে নিয়মিত অভিযান চালানোর পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিলেন বরিশালের পরিবেশ অধিদপ্তর। বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ৪৮০টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৫০টি ইটভাটা। বাকি ১৩৩টি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি। আর আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৪০০টি এবং সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি-(৮০-১২০ ফিট) ইটভাটা রয়েছে ৯০টি। জানায়ায়, জেলায় প্রায় ৩০০টির উপরে ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে জিগজ্যাক প্রায় ২১০টির মতো, পুরনো ফিক্সড পদ্ধতির ২৮টি ও পুরনো সনাতন পদ্ধতির নিষিদ্ধ ড্রাম চিমনি রয়েছে জেলার বিভিন্ন স্থানে। যার হিসাব বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরে নেই বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বরিশাল জেলায় প্রায় ২১০টি জিগজ্যাগ ইটভাটার ১১০টির পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে আর বাকি ১০০ টির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। যেসব ইটভাটার ছাড়পত্র নেই এসব ইটভাটা বছরের পর বছর বরিশাল প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পটুয়াখালী জেলায় ৮০ টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৫৫টি,ছাড়পত্র পায়নি ২৫টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৫৬টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ২০টি অধিক। বরগুনা জেলায় ৬০টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৫২টি,ছাড়পত্র পায়নি ৬টির অধিকার । এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৫৪টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ২টি। ভোলা জেলায় ৮৮টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৬৭টি, ছাড়পত্র পায়নি ২১ টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৮৩টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ২টি। তবে শুধু ভোলায় ৩টি হাইব্রিড হফম্যান কিলন অটো ব্রিকস রয়েছে।
ঝালকাঠী জেলায় ৩৯টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৪টি, ছাড়পত্র পায়নি ৫ টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ১৯টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ২০টি। পিরোজপুর জেলায় ৪২টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৪টি, ছাড়পত্র পায়নি ৮টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৩১টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ১১টি। এ ছাড়াও বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় আরও দেড় থেকে দুইশত অবৈধ ইটভাটা রয়েছে বলে দাবি করছেন একাধিক ইটভাটা ব্যবসায়ীরা। সূত্রমতে, বায়ুদূষণ কমানোর জন্য সরকার ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯) আইন জারি করেছে। আইনে রয়েছে কোনো ইটভাটা স্থাপন ও ইট পোড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। এছাড়া ইট পুড়তে জ্বালানি কাঠ ব্যবহারের পরিবর্তে কয়লা দিয়ে পোড়ার বিধান রয়েছে। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর গ্রামে মেসার্স আশার আলো, মেসার্স জে এ বি ব্রিকস, পরমানন্দসাহা গ্রামে মেসার্স হাজী ব্রিকস, কালিরবাজার গ্রামে এ বি এস ব্রিকস, রাখালতলা গ্রামে এস বি আই ব্রিকস, বাবুগঞ্জে ফাইন ব্রিকস, রাজ ব্রিকস, নিশা ব্রিকস, বন্দর থানার চরকাউয়া ইউনিয়নের চরকরনজী গ্রামে গড়ে ওঠা মেসার্স খান ব্রিকস, রানীরহাট সংলগ্ন মেসার্স নিপা ব্রিকস এবং মেসার্স আরএইচবি ব্রিকস, মেহেন্দিগঞ্জে মেসার্স ধনিয়া ব্রিকস, মেসার্স ওয়ান ব্রিকস, মেসার্স নাম্বার ওয়ান ব্রিকস, মেসার্স খান ব্রিকস, বাকেরগঞ্জে উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, ফরিদপুর ইউনিয়নের মিম ব্রিকস,এসটি ব্রিকস,এসটি টু ব্রিকস,এমটু ব্রিকস,ফাইভ এস্টার ব্রিকস, কবাই ইউনিয়নের কে এমবি ব্রিকস,মন্নান ব্রিকস,কলকাঠি ব্রিকসের অবৈধ ব্রিকস এর স্বর্গরাজ্য বলে জানা যায়, সহ পাণ্ডব নদীর চরে একতা ব্রিকস, শাপলা ব্রিকস, দুবাই ব্রিকস, গাজী ব্রিকস, আমতলী গ্রামে মেসার্স টু স্টার ব্রিকস, বাগদিয়া গ্রামে মেসার্স এইচ এন্ড এইচ ব্রিকস এবং নলুয়া গ্রামে মেসার্স ওয়ান নিপা ব্রিকসসহ বেশ কিছু ইটভাটায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিদিন কয়েকশ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। কিছু ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রাম চিমনি। বাকেরগঞ্জ ফরিদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ শফিক বলেন, এসব অবৈধ ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। এতে ভাটার আশপাশের এলাকা সব সময় বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। যাতে করে দেখা দিচ্ছে স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীসহ এলাকাবায় ছড়িয়ে পড়ছে শ্বাসকষ্ট রোগ সহ বিভিন্ন ধরনের বড় রোগ। তাই অত্রি এই অবৈধ ইটভাটা গুলো বন্ধ করা জরুরি।
কবাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহিরুল হক তালুকদার বলেন, অবৈধ ইটভাটার ফলে পরিবেশ ও ফসলের ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে যাতে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি। সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ না করলে আমাদের দেশেও দেখা দিবে খাদ্য সংকট। তাই এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান চলানো খুব জরুরি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, লোকালয়ে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার ধোঁয়ায় আশপাশের বাড়িগুলোর অনেক গাছ মরে গেছে। নারিকেল, সুপারি গাছে ফুল থেকে ফল ধরার কয়েক দিন পর তা ঝরে পড়ছে। অন্যান্য ফল গাছেরও একই অবস্থা। এসব ইটভাটা মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করেন না ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, অনেক ভাটা মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের জমি থেকেও মাটি কেটে নেয়া হয়।
তারা আরো জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একাধিকবার এসব অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তবে কিছু দিন যেতে না যেতেই পুনরায় ভাটাগুলোতে ইট পোড়ানো শুরু হয়। এদিকে ভাটা মালিকদের সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে বলেন, ইটভাটা স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন করেছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কিছু দিন আগে ভাটা পরিদর্শন করে গেছেন। এখনো ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আবেদন যখন করেছি, তখন অনুমোদন পাওয়া যাবে এমন আশায় তারা ভাটা চালু করেছেন। মেসার্স মক্কা ব্রিকস’র স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ বলেন, অবৈধ ইটভাটার ফলে বৈধ ইটভাটার মালিকরা লোকসানের দিকে যাচ্ছে প্রতিবছর। অবৈধ ইটভাটার মালিকরা বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ ইটভাটা তৈরি করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল’র সভাপতি প্রফেসর শাহ্ সাজেদা মনে করেন, ইটভাটার মালিকরা পুরোপুরি নিয়ম বিধি-বিধান আর পরিবেশের আইন না মেনেই নিজের ইচ্ছে মত জায়গায় এসব ইটভাটাগুলো তৈরি করছে। বেশি লাভবান হওয়ার জন্য কম টাকায় কাঠ, গাছ ও টায়ার দিয়ে নতুন ইট পুড়ছে। ফলে ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ু দূষণ করছে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের যোগসাজশে ইটভাটার মালিকরা ব্যবসা করেই যাচ্ছে। সরকারযন্ত্র কঠোর না হলে এসব ভাটাগুলোর সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়বে এবং পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিবে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক আঞ্জুমান আরা রজনী জানান, ইটভাটাগুলো বায়ু দূষণের পাশাপাশি কৃষিজমি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি করছে। মাটির উপরিভাগেই বেশি কৃষির উৎপাদন ক্ষমতা থাকে। কিন্তু ইটভাটাগুলো সেই মাটির উপরিভাগ কেটে নিয়েই ইট তৈরি করছে। ফলে দিনে দিনে কৃষির জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনৈতিকভাবেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক মো. আবদুল হালিম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের চোখ আড়াল করে ইট উৎপাদনের মৌসুমে মৌসুমি ইটভাটা ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে গড়ে তুলছে ড্রাম চিমনি ইটভাটা। কম বিনিয়োগে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য সহজেই নদীর চরের মাটি কেটে ইট তৈরি করছে তারা। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানোর ফলে দিন দিন বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি ফসলি উর্বর জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য অশনিসংকেত। তিনি বলেন, এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তর। নিয়মিত অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে ও হচ্ছে। পাশাপাশি ভাটায় থাকা কাঁচা ইট পানিতে ভিজিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা তৈরির নতুন আইন বাস্তবায়নের জন্য ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে মতবিনিময় সভা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও অবৈধ ইটভাটার মালিকদের বার বার নোটিশ দেয়া হচ্ছে, আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা ব্যবহারের জন্য।




