বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ষড়যন্ত্রের মূল হোতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে বঙ্গভবন দখল করে নেয়। তার চারপাশ ঘিরে থাকে খুনি চক্র। চারদিকে থমথমে অবস্থা। কোনো প্রতিবাদ নেই। আওয়ামীলীগের র্শীষ চার নেতা জেলে। অনেকেই আত্মগোপনে। অনেকেই যোগ দিয়েছেন মোশতাকের মন্ত্রীসভায়। বঙ্গভবনে গিয়ে শপথও নিয়েছেন তারা।
এই টালমাটাল অবস্থায় অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গভবনে আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্যদের বৈঠক ডাকেন খন্দকার মোশতাক। সেই বৈঠকে যোগ দেন কসবা-আখাউড়া নিয়ে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ঘনিস্ট সহচর অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। বঙ্গভবনের দরবার হলে বৈঠকে যোগ দেন অন্যান্য সংসদ সদস্যরাও। সবাই নীরব নিশ্চুপ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিদের আশ্রয়ে খন্দকার মোশতাক বিনা প্রতিবাদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে নেন। কিন্তু একেবারে বিনা চ্যালেঞ্জে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হয়ে সংসদ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করতে পারেননি মোশতাক। সংসদীয় দলের বৈঠকে বঙ্গভবনেই তাকে চ্যালেঞ্জ করেন একজন।। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন খন্দকার মোশতাককে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানেন না।মোশতাক অবৈধ প্রেসিডেন্ট। এ নিয়ে চলে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। মোশতাককে ঘিরে রাখা খুনি চক্র রাইফেল তাক করে গুলি করার জন্য। কিন্তু তিনি থামেন নি।মোশতাকের ক্ষমতাকে প্রকাশ্যে প্রথম চ্যালেঞ্জকারী সেই ব্যক্তিটি ছিলেন সিরাজুল হক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যবন্ধু।
একজন খ্যাতিমান আইনজীবী । জীবন সায়াহ্নে যিনি তার বন্ধু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার মামলায় রাষ্ট্রেপক্ষের প্রধান আইনজীবী হিসেবে দায়িত্বপালন করে বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করে গেছেন।
খুনি মোশতাকের ‘চোখে চোখ রেখে করা এই প্রতিবাদ করার সাহস আর কেউ দেখাতে পারেন নি সিরাজুল হক ছাড়া। সে দিন এই ঘটনার বর্ণনা বিচ্ছিন্ন ভাবে জানা যায়। তবে বঙ্গভবনে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এমন দুজন সংসদ সদস্য বিষয়টি বিভিন্ন সময় বর্ননা করেছেন। তাদের একজন কুমিল্লার সংসদ সদস্য মরহুম অধ্যাপক আলী আশরাফ ও প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মুসা। অধ্যাপক আলী আশরাফ গতবছর মারা গেছেন। বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে অধ্যাপক আলী আশরাফ সেদিনের সেই ঘটনা স্মরণ করে বলেন, সিরাজুল হক যখন অগ্মিশর্মা হয়ে মোশতাকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তখন খুনিরা সামরিক পোশাকে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তাদের দৃঢ় উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল এবং বন্দুক নাড়াচাড়া করছিল। ঘটনাস্থলের সকলেই তখন ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিল।
ওইদিন বঙ্গভবনে মোশতাকের সঙ্গে সিরাজুল হকের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মধ্যদিয়ে বৈঠকটি আকস্মিকভাবে শেষ হয়ে যায়।
মোশতাক মূলত এসব বৈঠক ডেকেছিলেন বন্দুকের জোরে আইন প্রণেতাদের আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করতে। এ ধরণের দুটি বৈঠক ডেকেছিল মোশতাক। কিন্তু ওই দুই বৈঠকেই সিরাজুল হক তার রাষ্ট্রপতিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।
সিরাজুল হক খন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।মুখের উপর তিনি বলেছিলেন ‘আজ আমি আপনাকে রাষ্ট্রপতি ডাকতে পারছি না। আমি আপনাকে মোশতাক ভাই বলতে পারি। কিন্তু আমি যে খন্দকার মোশতাককে জানতাম আপনি এখন আর সেই মোশতাক নন বলে আমি আপনাকে মোশতাক ভাইও ডাকতে পারছি না। তাই, আপনাকে আমি কিছুই ডাকছি না।
মোশতাককে স্মরণ করিয়ে দেন, বঙ্গবন্ধু ও তার উভয়ের সঙ্গে মোশতাকের ২৭ বছরের ঘনিষ্ঠতার কথা, যখন তারা এমনকি এক থালার খাবারও ভাগাভাগি করে খেয়েছেন তখন তিনি (মোশতাক) কখনই বঙ্গবন্ধুর কোন সিদ্ধান্তের সমালোচনা কিংবা কোন অভিযোগ করেননি। আর আজ আপনি বলছেন বঙ্গবন্ধু চোর, আপনি ভালো মানুষ , আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব? আপনি বলছেন আমাকে তা দেখতে? কতো বড় সাহস আপনার।
ওই সময়ে ঘটনাস্থলে অভ্যুত্থানকারীদের একজন সিরাজুল হককে লক্ষ্য করে বন্দুক তাক করলে তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘মেজর, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি না। আমি তার (মোশতাকের) সঙ্গে কথা বলছি। কারণ, তিনি আমাদেরই একজন ছিলেন। আপনি আমাকে হত্যা করতে চাইলে পাঁচ মিনিট পরে করুন। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা আমাকে শেষ করতে দিন।’
বৈঠকে সিনিয়র সংসদ সদস্যদের মোশতাকের তৈরি লিস্ট ধরে কথা বলার জন্য ডাকা হচ্ছিল তারা মোশতাক ও অভ্যুত্থানকারিদের রোষ থেকে বাঁচতে সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এবিএম মুসা যিনি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে বঙ্গভবনে ওই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন । তিনি তার স্মৃতিকথায় সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে লিখেন, সিরাজুল হকের কথায় সেদিন ঘটনাস্থলে দু’জন মেজর উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। পরে মোশতাকের ইশারায় তারা কামরা থেকে বেরিয়ে যান। এ বি এম মুসা আরো লেখেন, এরপর সিরাজুল হক সরাসরি প্রশ্ন করেন, আপনি কেন মুজিবকে হত্যা করেছেন?
মোশতাকের জবাব ছিল, এই হত্যাকান্ডের প্রয়োজনীয়তা কি ছিল তা জনগণ যথাসময়ে উপলদ্ধি করতে পারবে।
মুসা আরো বলেন, সিরাজুল হক তখন বলেছিলেন প্রয়োজনীয়তাটা কি ছিল তা জানতে আমি অপেক্ষা করবো। তা না জানা পর্যন্ত আমরা আপনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি না।
মোশতাককে উদ্দেশ্য করে সিরাজুল হক বলেন, আপনি সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কথা বলছেন। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসুন। আমি আপনার গালে চড় মারব। সিরাজুল হকেরি এমন মন্তব্যের পরই হৈ হট্টগোল বেঁধে যায় এবং কার্যত প্রত্যেকে পালিয়ে যাওয়ায় বৈঠকও শেষ হয়ে যায়।
অধ্যাপক আলী আশরাফ স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ওই দিনের বৈঠকের স্থান ছিল বঙ্গভবনের দরবার হল। কিন্তু অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক লোকজন চারপাশ ঘিরে থাকায় দরবার হলকে মনে হচ্ছিল অবরুদ্ধ কোন কম্পার্টমেন্ট।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বিধায় তিনি ভয় পাচ্ছিলেন খুনীরা হয়তো গোলাগুলি শুরু করবে। তিনি বলেন, আমি সিরাজুল হকের বাহু আঁকড়ে ধরে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসি কারণ তখন সকলেই পালাচ্ছিল।
পরিস্থিতি আমাকে খুবই ঘাবড়ে দেয়। আমি ভয় পাচ্ছিলাম- খুনীরা হয়তো সিরজুল হকের পিছু নেবে। আমি তার গাড়িতে আর না চড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই, তাকে বলেছিলাম, আমি হেঁটেই যেতে পারব।
ভাগ্য ভালো খন্দকার মোশতাক আর খুনি চক্র সিরাজুল হককে কছিু করতে সাহস পায়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী সিরাজুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ।
অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের ২০ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (শুক্রবার)। তিনি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের পিতা।
সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কসবা-বুড়িচং নিয়ে গঠিত তৎকালীন কুমিল্লা-৪ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কসবা-আখাউড়া নিয়ে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
সিরাজুল হক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষের অন্যতম প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জাতীয় চারনেতা হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলিও ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষের আইনজীবী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন সিরাজুল হক। অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ১৯২৫ সালের ১ আগস্ট কসবা উপজেলার পানিয়ারূপ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর এই মহান ব্যক্তিত্ব পরলোক গমন করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০২২ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মহান এই ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকিীতে জানাই শ্রদ্ধা।
(লেখক: সাংবাদিক)