ঢাকা | শুক্রবার
২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাড়ি-পাতিলে ধানসিদ্ধ

হাড়ি-পাতিলে ধানসিদ্ধ

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। কালের বিবর্তনে গ্রামীণ নারীদের হাড়ি-পাতিলে ধান সিদ্ধ প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে। আবহমান বাংলার চিরায়িত ঐতিহ্য হাড়ি-পাতিলের ধানসিদ্ধ, শুকানো দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। গেল কয়েক বছর আগে নীলফামারীর ছয়টি উপজেলার গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দেখা যেত ধানসিদ্ধ করা পাতিল। যা ছিল নারীদের কাছে প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থালি উপকরণ। সিদ্ধ করার আগে মাটির বড় হাড়ি, হাউদা বা চারিতে সকালে ধান ভিজিয়ে রাখতো। ধান সিদ্ধ করার জন্য বানানো হতো মাটির চৌকা, তিন কোন বিশিষ্ট ইটের টিয়া। এর ওপরে বসানো হতো ২০ থেকে ৪০ কেজি পরিমাপের পিতল কিংবা সিলভারের পাতিল। চুলায় আগুন জ্বালানো হত তুষ দিয়ে। যখনই চুলার মধ্যে ছিটিয়ে দেয়া হয় তুষ তখনই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠতো আগুন। সে আগুনে রাঙা হয়ে ওঠতো গাঁয়ের কিষাণ বধূর মুখ।

শীত আর কুয়াশা যতই তীব্র হোক, গভীর কিংবা শেষ রাতে শুরু হত ধান সিদ্ধ করার পালা। যা চলত প্রায় দুপুর পর্যন্ত। পরে সিদ্ধ করা ধান মেলে দেয়া হত রোদে। খানিক পরপর ঝাড়ু-বারুন দিয়ে বাইন্না (নেড়ে) দেয়া হত। দুই-এক দিনেই শুকানো ধানে হত চাল। যা কৃষকের সারা বছরের খোরাকি (খাবার)। ধান ভিজানো, সিদ্ধ এবং শুকানোর এ প্রক্রিয়া গ্রামীণ জীবনের এক অনবদ্য চিত্রকল্প বহন করত। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিজ্ঞান আর তথ্য প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি কলকারখানার কারণে গ্রামের কৃষাণ-কৃষাণী বধুরা আর পাতিলে ধানসিদ্ধ করে না। এতে চিরায়ত গ্রাম-বাংলার অনবদ্য দৃশ্য হারিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে জেলার কিশোরগজ্ঞ উপজেলার বাহাগিলী ইউপির উত্তর দুরাকুটি পশ্চিমপাড়া গ্রামে ধানসিদ্ধ-শুকানোর এমন চিত্র দেখা মেলে। এসময় ধানসিদ্ধ কাজে নিয়োজিত গৃহবধূ মোসলেমা বেগম ধৌলি জানান, আগে প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতে ফসল কাটার মৌসুমে ধানকাটা থেকে শুরু করে সিদ্ধ-শুকানো ও নবান্নের উৎসব চলতো। ধানসিদ্ধ-শুকানোর কাজ নারীরাই করত বেশি। পাশাপাশি বারানি পরিবারের মহিলারা ধান সিদ্ধ ও শুকিয়ে ঢেঁকিতে ছেঁটে চাল বাজারে বিক্রি করতো। এটি ছিল যুগের পর যুগ গ্রাম-বাংলার চিরায়ত ধারা। এ ধারা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ধান সিদ্ধ, শুকানো, ভাঙানোর ঝামেলা এড়াতে সবাই বাজারে অটো রাইস মিলের চালের দিকে ঝুঁকছেন। অটো রাইস মিলের ধবধবে পালিশ করা চালের পুষ্টিগুণ কম। সিদ্ধ করা ধানের (পালিশহীন) ঢেঁকি ছাটা চাল সু-স্বাদু ও পুষ্টিগুণ বেশি। চাল যত চকচকে হয়, সেটার গুণ তত কম হয়। আর এ চালের ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। যেহেতু বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। এক্ষেত্রে ঢেঁকিছাঁটা চাল ঝুঁকিমুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত। একসময় গ্রামাঞ্চলের মানুষ এ চাল খেতেন। এমনকি শহরের বাসিন্দারাও। সেই অভ্যাসটি হারিয়ে গেছে বললেই চলে। এখন ধান সিদ্ধ-শুকানো ও ভাঙ্গানোর যান্ত্রিক পদ্ধতি আসায় প্রাচীন আমলের সেই ধারা আর তেমন চোখে পড়েনা।

সংবাদটি শেয়ার করুন